অর্থনীতি

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানের ওপর ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা চায় ইউক্রেন

রাশিয়ার অধিকৃত ইউক্রেনীয় অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা গম বাংলাদেশে আমদানি হচ্ছে—এমন অভিযোগ তুলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কাছে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক শীর্ষ কূটনীতিক ও ভারতস্থ রাষ্ট্রদূত ওলেক্সান্ডার পোলিশচুক এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, একাধিকবার সতর্ক করেও বাংলাদেশ সরকার রাশিয়া-অধিকৃত অঞ্চল থেকে গম আমদানি বন্ধ করেনি, ফলে তারা বিষয়টি ইইউ’র নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করতে যাচ্ছে।

ইউক্রেনের অভিযোগ ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ

রাষ্ট্রদূত পোলিশচুক বলেন, “বাংলাদেশ এমন এক কাজ করছে যা আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থী। চুরি হওয়া গম আমদানি শুধু ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের অবমাননা নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ। বাংলাদেশ সরকার কোনো সদুত্তর দেয়নি, এজন্য আমরা বিষয়টি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টিতে আনবো।”

ইউক্রেনীয় দূতাবাসের পক্ষ থেকে ২০২৫ সালে বাংলাদেশ সরকারকে পাঠানো চারটি কূটনৈতিক চিঠিতে স্পষ্টভাবে অনুরোধ জানানো হয়, যেন ১ লাখ ৫০ হাজার টনের বেশি গমের আমদানি বন্ধ করা হয়। এসব গম রাশিয়ার ককেশাস অঞ্চলের বিভিন্ন বন্দর—বিশেষ করে সেভাস্তোপল, কের্চ ও বার্দিয়ানস্ক থেকে রপ্তানি হয়েছে বলে ইউক্রেন দাবি করছে। ইউক্রেনের মতে, এসব এলাকা তাদের ভূখণ্ডের অংশ এবং বর্তমানে রাশিয়ার সামরিক দখলে রয়েছে। সুতরাং এখানকার যে কোনো সম্পদ রপ্তানি অবৈধ এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সেটি “লুটপাটের ফল” হিসেবে বিবেচিত হবে।

চিঠিগুলোর প্রতিটিতে সংশ্লিষ্ট জাহাজের নাম, রেজিস্ট্রেশন নম্বর এবং রুটসহ বিস্তারিত তথ্যও যুক্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ ১১ জুন পাঠানো চিঠিতে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়, যদি বাংলাদেশ সরকার এই গম গ্রহণ করে তবে তারা শুধু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানই নয়, সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা ও কর্মকর্তারাও ইইউ নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে পারে।

বাংলাদেশের অবস্থান ও সরকারি প্রতিক্রিয়া

এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, “বাংলাদেশ সরকার কখনো এমন কোনো গম আমদানি করেনি যার উৎপত্তি রাশিয়া-অধিকৃত ইউক্রেনীয় অঞ্চল থেকে। এটি বিভ্রান্তিকর ও ভিত্তিহীন অভিযোগ।” তবে তিনি স্বীকার করেন, সরকার আমদানি উৎস সম্পর্কে বিস্তারিত ট্রেসিং সবসময় করতে পারে না, বিশেষ করে যখন গম একাধিক মধ্যস্থ প্রতিষ্ঠানের হাত ঘুরে আসে।

এদিকে সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি। রাশিয়া সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য আসেনি।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান

ইইউ’র পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিষয়ক মুখপাত্র আনিতা হিপার জানান, ইউক্রেনের অভিযোগে যেসব জাহাজের নাম এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “যদি উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় যে উল্লিখিত জাহাজগুলো চুরি হওয়া গম পরিবহনে জড়িত, তাহলে ভবিষ্যতে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে।”

তিনি আরও জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যে রাশিয়ার তথাকথিত ‘শ্যাডো ফ্লিট’-এর অন্তর্ভুক্ত ৩৪২টি জাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এসব জাহাজ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল, অস্ত্র ও খাদ্যশস্য রপ্তানিতে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

গমের উৎস চিহ্নিত করা কতটা সম্ভব?

রাশিয়ার দিক থেকে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, দখলকৃত অঞ্চল এখন রাশিয়ার অংশ। তাই সেখানে উৎপাদিত গমও রাশিয়ান গম হিসেবেই বিবেচিত হবে। রাশিয়ার একজন গম ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “গমের উৎস শনাক্ত করা খুবই কঠিন। এটা হীরা বা সোনা নয়, যার উৎস রাসায়নিক গঠনের মাধ্যমে জানা যায়। গম একবার প্রক্রিয়াজাত হলে সেটি কোথা থেকে এসেছে, তা বোঝা প্রায় অসম্ভব।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্যশস্যের ট্রেসেবিলিটি (traceability) প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী এখনও বেশ দুর্বল, বিশেষ করে কৃষিভিত্তিক পণ্য ও শস্যের ক্ষেত্রে। ফলে কোনো একটি চালান ঠিক কোথা থেকে এসেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন।

বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশ-রাশিয়া সম্পর্ক

রুশ গম পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান রুসআগ্রোট্রান্স জানিয়েছে, ২০২৫ সালের মে মাসে বাংলাদেশ রাশিয়ান গমের চতুর্থ বৃহত্তম ক্রেতা ছিল। এতে স্পষ্ট যে, রাশিয়া-বাংলাদেশ কৃষিপণ্য বাণিজ্য ক্রমবর্ধমান রয়েছে এবং এটি বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বিশ্লেষকদের মতে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক গম বাজারে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, সেটি মোকাবেলায় বাংলাদেশ বিকল্প সরবরাহ উৎস হিসেবে রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকছে। তবে এতে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতা বাড়ার আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা

এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ইউক্রেনের এ উদ্যোগ একটি রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল হতে পারে, যার মাধ্যমে ইউক্রেন চায় বাংলাদেশকে নিরপেক্ষতা ত্যাগ করে তাদের পক্ষে অবস্থান নিতে। যদিও বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে এবং রাশিয়া ও ইউক্রেন—উভয়ের সঙ্গেই কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখছে।

একইসঙ্গে এ ঘটনা আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়, যুদ্ধকালীন অঞ্চলের সম্পদ ও পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে উপস্থিতি কেবল অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক সংকটও তৈরি করতে পারে। যদি বাংলাদেশ সত্যিই রাশিয়া-অধিকৃত এলাকা থেকে গম আমদানি করে থাকে, তবে ইইউ নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে সেটি বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

উপসংহার

ইউক্রেনের অভিযোগ এবং ইইউ নিষেধাজ্ঞার হুমকি বাংলাদেশের জন্য একটি কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। সরকার যদি দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে বিষয়টির ব্যাখ্যা না দেয় কিংবা গম আমদানির উৎস নিরূপণে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক দূরদর্শিতা ও স্বচ্ছ বাণিজ্যনীতি অনুসরণের।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button