অর্থনীতি

বাংলাদেশকে ১৩০ কোটি ডলার ঋণ দেবে এডিবি

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাংলাদেশের জন্য ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৩০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ঋণ সহায়তা অনুমোদন করেছে, যা বর্তমান বাজারদরে (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসেবে) দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ১৫ হাজার ৯০৯ কোটি টাকার সমান। এই ঋণের মধ্যে ৯০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা হিসেবে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, স্থিতিশীলতা এবং জলবায়ু সহনশীলতা কার্যক্রমে ব্যয় করা হবে। এছাড়া, অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ থাকছে ৪০ কোটি ডলার। এই ঋণ সহায়তার আওতায় বাংলাদেশ সরকার এবং এডিবির মধ্যে চারটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাজেট সহায়তা ও চুক্তি স্বাক্ষর

৯০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা গত বৃহস্পতিবার (১৯ জুন ২০২৫) ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় এডিবির সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় অনুমোদিত হয়। এই অর্থ চলতি জুন মাসের মধ্যেই বাংলাদেশের হাতে পৌঁছাবে। এর ধারাবাহিকতায় শুক্রবার (২০ জুন ২০২৫) ঢাকায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং এডিবির মধ্যে দুটি ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়া, ২০ কোটি ডলার করে আরও দুটি চুক্তি সম্পন্ন হয়, যা অবকাঠামো এবং বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে ব্যবহৃত হবে।

ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী এবং বাংলাদেশে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হোয়ে ইউন জিয়ং এই চারটি চুক্তিতে সই করেন। এডিবির বাংলাদেশ কার্যালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই ঋণ সহায়তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে ৫০ কোটি ডলার

এডিবির ঋণ সহায়তার মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ, অর্�つまり ৫০ কোটি ডলার, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা ও সংস্কার কার্যক্রমে ব্যয় করা হবে। এই অর্থের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করা, করপোরেট সুশাসন উন্নত করা, সম্পদের গুণগত মান বৃদ্ধি এবং আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

ব্যাংকিং খাতের সংস্কার কর্মসূচি, উপ-প্রোগ্রাম–১ এর আওতায় নীতিগত সংস্কারের ওপর জোর দেওয়া হবে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো আর্থিক খাতকে আরও স্থিতিশীল ও টেকসই করে গড়ে তোলা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা কাঠামোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি, ব্যাংকগুলোর সুশাসন উন্নয়ন এবং বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ দ্রুত সমাধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হোয়ে ইউন জিয়ং বলেন, “বাংলাদেশ বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক পরিসরে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। এই ঋণ সহায়তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে, ব্যাংকগুলোর সুশাসন জোরদার করবে এবং সম্পদের মান উন্নত করে আর্থিক খাতকে প্রবৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত করবে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, এই সংস্কার কার্যক্রম দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করবে।

জলবায়ু সহনশীলতায় ৪০ কোটি ডলার

এডিবির ঋণ সহায়তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো জলবায়ু সহনশীলতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য ৪০ কোটি ডলার। এই অর্থ জলবায়ু অর্থায়ন সহজতর করা, বাংলাদেশ জলবায়ু উন্নয়ন অংশীদারত্ব গঠন এবং দুর্যোগ ঝুঁকি অর্থায়নের কৌশল প্রণয়নের জন্য ব্যবহৃত হবে।

হোয়ে ইউন জিয়ং এ প্রসঙ্গে বলেন, “এই কর্মসূচি জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধির জন্য নীতিমালা, অর্থায়ন, প্রতিষ্ঠান এবং অবকাঠামোতে সমন্বিত সংস্কার আনবে। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই ভিত্তি গড়ে তুলবে এবং বাংলাদেশকে জলবায়ু-স্মার্ট প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।” তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী করতে এই অর্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

অবকাঠামো উন্নয়নে ২০ কোটি ৪০ লাখ ডলার

এডিবির ঋণের আরেকটি অংশ, ২০ কোটি ৪০ লাখ ডলার, ঢাকা–উত্তর পশ্চিম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করিডর উন্নয়নে ব্যয় করা হবে। এই প্রকল্পের আওতায় এলেঙ্গা থেকে হাটিকুমরুল হয়ে রংপুর পর্যন্ত ১৯০ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে। এছাড়া, সড়ক নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য ফুট ওভারব্রিজ, ফুটপাত এবং ধীরগতির যানবাহনের জন্য দুই লেনের পৃথক সড়ক নির্মাণ করা হবে।

এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সংযোগ আরও শক্তিশালী করবে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে।

বিদ্যুৎ খাতে ২০ কোটি ডলার

অবশিষ্ট ২০ কোটি ডলার বিদ্যুৎ সরবরাহের মান ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের উন্নয়নে ব্যয় করা হবে। এই অর্থের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার দক্ষতা বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের সম্প্রসারণ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসে বিনিয়োগ বাড়ানো হবে। এটি বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করবে।

অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব

এডিবির এই ঋণ সহায়তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়নে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের সংস্কার দেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও দক্ষ করে তুলবে, যা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে। একই সঙ্গে, জলবায়ু সহনশীলতা কর্মসূচি বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আরও প্রস্তুত করবে। অবকাঠামো এবং বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে।

উপসংহার

এডিবির ১৩০ কোটি ডলার ঋণ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই সহায়তা ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, জলবায়ু সহনশীলতা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশ সরকার এবং এডিবির এই যৌথ উদ্যোগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শক্তিশালী ও টেকসই অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তুলবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button