ফ্যাক্ট চেক

গরমে সীমিত থাকবে লোডশেডিং, পরিস্থিতি সহনীয় রাখার আশ্বাস

চলতি গ্রীষ্মে দেশে লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা থাকলেও তা সহনীয় পর্যায়ে সীমিত রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান।

শনিবার রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তিনি বলেন, “গ্রাম ও শহরের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহে এবার কোনো বৈষম্য থাকবে না। সবার জন্য সমভাবে বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে চাই আমরা।”

বকেয়া বিল কমিয়ে আনাই ছিল অগ্রাধিকার

জ্বালানি উপদেষ্টা জানান, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই জ্বালানি খাতের আর্থিক সমস্যাগুলোর সমাধানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে, আগের সরকারের রেখে যাওয়া প্রায় ৩.২ বিলিয়ন ডলার বকেয়া বিল কমিয়ে বর্তমানে মাত্র ৬০০ মিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে।

তিনি বলেন, “জ্বালানি আমদানিতে নির্ভরশীল দেশের জন্য বকেয়া বিল বড় একটি বোঝা ছিল। এই অল্প সময়ের মধ্যেই তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনতে পেরেছি, যাতে বিদেশি জ্বালানি সরবরাহকারীদের আস্থা ফিরে আসে এবং আমদানি অব্যাহত থাকে।”

লোডশেডিং হবে, তবে সীমিত পর্যায়ে

উপদেষ্টা স্বীকার করেন, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অনেক হলেও, জ্বালানির ঘাটতির কারণে মাঝে মধ্যেই সরবরাহ বিঘ্নিত হতে পারে। তবে সরকার এমনভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে যাতে এই লোডশেডিং সহনীয় ও স্বল্পস্থায়ী হয়।

বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে এবং দিনে দিনে সেটি আরও চাপ তৈরি করে। এই চাপে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে সরকার চায় যেন এই পরিস্থিতি জনভোগান্তিতে পরিণত না হয়।

সংস্কার প্রয়োজন, সময় কম

ফাওজুল কবির খান বলেন, “বর্তমানে আমরা একটি স্বল্পমেয়াদি অন্তর্বর্তী সরকার। সামনে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে এই স্বল্প সময়ের মধ্যে জ্বালানি খাতের সকল কাঠামোগত সংস্কার করা সম্ভব নয়। তবে যে সংস্কারগুলো এখনই করা যায়, সেগুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।”

তিনি জানান, পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে সিস্টেম লস (চুরি, লিকেজ, অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি) ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার টার্গেট নেওয়া হয়েছে। “গ্যাস লাইন লিকেজ যেখানে আছে, তা বন্ধ করা হচ্ছে। গ্যাস চুরি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে,” বলেন উপদেষ্টা।

বেতন-ভাতা নয়, চাই দক্ষতা ও জবাবদিহি

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের কিছু প্রতিষ্ঠানে বেতন ছাড়া বছরে ৩০ থেকে ৪০টি অতিরিক্ত পেমেন্ট দেওয়া হয়—এমন তথ্য দিয়ে ফাওজুল কবির বলেন, “এই অস্বাভাবিক সুবিধা বন্ধ করা হবে। অ্যাপল-গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানেও এমন বাড়তি সুবিধা নেই। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এসব অপচয় রোধ করতে হবে।”

তিনি বলেন, “কাজের দক্ষতা বাড়িয়ে, জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভজনক করা হবে। বেতন-ভাতা নয়, কর্মদক্ষতা ও স্বচ্ছতা হবে রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর প্রধান গুণ।”

বিদ্যুৎ সরবরাহে সমতা আনাই লক্ষ্য

অতীতে দেখা গেছে, লোডশেডিংয়ের সময় শহর ও গ্রামে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মাত্রায় বড় ধরনের পার্থক্য ছিল। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা চলে আসছিল। এবারের গ্রীষ্মে সরকার এই ব্যবধান কমিয়ে সমতা আনার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে বলে উপদেষ্টা জানান।

তিনি বলেন, “ঢাকা বা গ্রামে বসবাসকারী—সব নাগরিকের জন্য বিদ্যুৎ সেবা সমানভাবে প্রাপ্য হওয়া উচিত। আমরা সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছি।”

জ্বালানি খাতের দীর্ঘমেয়াদি সংকট

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়লেও জ্বালানি সরবরাহ ঘাটতি ও আর্থিক অনিয়ম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বাড়ছে, অথচ বিতরণে সুশাসনের অভাব, পুরনো অবকাঠামো এবং বাণিজ্যিক ও আবাসিক চুরির কারণে বড় অংকের ক্ষতি গুনতে হয় সরকারকে।

তাদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য টেকসই নীতিমালা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।

এই গ্রীষ্মে দেশজুড়ে তীব্র গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে—এটা জানা কথা। তবে সরকার যদি সত্যিই লোডশেডিং সীমিত ও সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারে, এবং শহর-গ্রাম বৈষম্য দূর করে অন্তত ন্যূনতম সমতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়, তবে সেটি হবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একটি ইতিবাচক অর্জন।

অবশ্যই জ্বালানি খাতের কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন, যা সময়সাপেক্ষ। তবে চুরি রোধ, লিকেজ কমানো, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধের মতো দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপগুলি বাস্তবায়িত হলে, দেশের জ্বালানি খাত আবারও স্থিতিশীলতার দিকে ফিরতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button