রংপুরের একজন ব্যবসায়ী আশরাফুল হককে (৪০) প্রেমের ফাঁদে ফেলে কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। মূল অভিযুক্ত হলেন তার বন্ধু জরেজুল ইসলাম ও তার প্রেমিকা শামীমা আক্তার ওরফে কোহিনুর (৩৩)। র্যাব-৩ জানিয়েছে, নিহতের সঙ্গে মিথ্যা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে তারা অন্তরঙ্গ ভিডিও ধারণের চেষ্টা করেছিল, যা দেখিয়ে ব্যবসায়ী আশরাফুল হক থেকে অর্থ আদায় করা যায়।
আজ শনিবার (১৫ নভেম্বর) কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল ফায়েজুল আরেফীন।
গ্রেপ্তার ও হত্যাকাণ্ডের সময়রেখা
লে. কর্নেল ফায়েজুল আরেফীন জানান, ১৪ নভেম্বর কুমিল্লার লাকসামের বড় বিজরা এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে শামীমা আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার আগে, ১১ নভেম্বর রাত ৮টায় ব্যবসায়ী আশরাফুল হক তার পাওনা আদায়ের জন্য একই গ্রামের বন্ধু জরেজুল ইসলামের সঙ্গে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
পরদিন সকালে আশরাফুলের পরিবারের সঙ্গে তার মোবাইল যোগাযোগ বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর ১৩ নভেম্বর হাইকোর্ট সংলগ্ন এলাকায় দুইটি নীল রঙের ড্রামে ২৬ খণ্ডে বিভক্ত এক অজ্ঞাত ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সিআইডি আঙ্গুলের ছাপ বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত করে, মরদেহটি নিখোঁজ ব্যবসায়ী আশরাফুল হকের।
হত্যাকাণ্ডে পরিকল্পিত ধাপ
র্যাব জানিয়েছে, শামীমার সঙ্গে জরেজুল ইসলামের এক বছরের বেশি সময় ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। জরেজ শামীমাকে জানান, তার এক বন্ধুকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইল করে ১০ লাখ টাকা আদায় করা সম্ভব। এই টাকার মধ্যে ৭ লাখ টাকা নিজে নেওয়া হবে, ৩ লাখ টাকা শামীমার জন্য নির্ধারণ করা হয়।
শামীমা এক মাস আগে মোবাইল ফোনে আশরাফুলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। ধাপে ধাপে প্রেমের সম্পর্কের আড়ালে তারা নিয়মিত অডিও এবং ভিডিও কলে যুক্ত থাকেন। পরে ১১ নভেম্বর রাত ৮টায় তারা ঢাকায় পৌঁছান। ১২ নভেম্বর তিনজন ঢাকার শনির আখড়ার নূরপুর এলাকায় ৫,৫০০ টাকায় একটি বাসা ভাড়া করে বাসা ভাড়া নেন।
অন্তরঙ্গ ভিডিওর পরিকল্পনা ও হত্যাকাণ্ড
র্যাব জানিয়েছে, রংপুর থেকে ঢাকায় আসার আগে জরেজ শামীমাকে ফোনে বলেন, আশরাফুলের সঙ্গে শামীমা অন্তরঙ্গ ভিডিও ধারণ করবে। পরে ভিডিও দেখিয়ে ১০ লাখ টাকা আদায়ের চেষ্টা করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী শামীমা আশরাফুলকে মালটার শরবতের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হালকা অচেতন করেন। এরপর জরেজ বাইরে থেকে ভিডিও ধারণ করেন।
১২ নভেম্বর দুপুরে আশরাফুল সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে গেলে জরেজ তার হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে মুখ স্কচটেপ দিয়ে আটকান। অতিরিক্ত ইয়াবা সেবন করে উত্তেজিত জরেজ হাতুড়ি দিয়ে অচেতন আশরাফুলকে মারতে থাকেন। অতিরিক্ত আঘাত এবং শ্বাসরোধের কারণে আশরাফুল ঘটনাস্থলেই মারা যান।
লাশ গুম করার চক্রান্ত
র্যাবের ব্রিফিংয়ে বলা হয়, ১৩ নভেম্বর সকালে জরেজ নিকটস্থ বাজার থেকে চাপাতি এবং ড্রাম কিনে আনে। তারপর চাপাতি দিয়ে লাশ ২৬ টুকরা করে দুইটি নীল রঙের ড্রামে ভরে রাখে। দুপুর ২টা ৪৩ মিনিটে একটি সিএনজি ভাড়া করে ড্রাম দুটি নিয়ে বের হয়। পরে সিএনজি পরিবর্তন করে হাইকোর্টের পানির পাম্প সংলগ্ন প্রধান সড়কের পাশে একটি বড় গাছের নিচে ফেলে দেয়।
পরে তারা সায়েদাবাদে চলে যান এবং শামীমা কুমিল্লার নিজের বাড়িতে ফিরে যান।
র্যাবের তদন্ত ও মূল উদ্দেশ্য
র্যাব জানিয়েছে, শামীমার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ উপার্জন। তবে হত্যাকাণ্ডের পেছনে পূর্ব শত্রুতা ছিল কি না, তা জরেজুল ইসলামের জিজ্ঞাসা করার মাধ্যমে জানা যাবে।
গ্রেপ্তারি ও মামলা
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত জরেজুল ইসলামকে ইতোমধ্যে ডিবি গ্রেপ্তার করেছে। নিহতের বোন বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেছেন। শামীমা আক্তারও গ্রেপ্তারকৃত।
এই হত্যাকাণ্ড সমাজে প্রেমের ফাঁদ এবং ব্ল্যাকমেইলের বিপজ্জনক বাস্তবতা প্রকাশ করেছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার, মানসিক চাপ এবং অর্থলিপ্সার কারণে সম্পর্ক ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মকে সতর্ক থাকতে হবে অনলাইন পরিচিতি এবং ব্যক্তিগত ভিডিওর ক্ষেত্রে।
MAH – 13810 I Signalbd.com



