ফ্যাক্ট চেক

২৪ ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির গণ-আত্মহত্যার চেষ্টা, যা জানা গেল

Advertisement

ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের ইন্দোর শহর এক ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী হয়েছে। শহরের নন্দলালপুরা এলাকায় বসবাসকারী প্রায় ২৪ জন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি একসঙ্গে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তাঁরা ফিনাইল বা ফ্লোর ক্লিনার পান করে জীবন শেষ করার চেষ্টা করেন। দ্রুত উদ্ধার অভিযান চালিয়ে তাঁদের মহারাজা যশবন্তরাও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁদের অবস্থা আপাতত স্থিতিশীল হলেও মানসিকভাবে তাঁরা ভীষণ আঘাতপ্রাপ্ত।

ঘটনার সূচনা – এক রাতে হঠাৎ আতঙ্ক

ঘটনাটি ঘটে বৃহস্পতিবার রাতের দিকে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নন্দলালপুরা এলাকার একটি বাড়ি থেকে হঠাৎ চিৎকার ও কান্নার শব্দ শুনে তাঁরা বাইরে বের হন। পরে দেখা যায়, ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের কয়েকজন মাটিতে পড়ে আছেন এবং কয়েকজন বমি করছেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীরা পুলিশে খবর দেন।

ইন্দোর পুলিশের ডেপুটি কমিশনার আনন্দ কালাগদি জানান, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডেকে অসুস্থ ব্যক্তিদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, তাঁরা সবাই একই সম্প্রদায়ের সদস্য এবং গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব ও মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন।

গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব ও হেনস্তা: পুলিশের প্রাথমিক ধারণা

ইন্দোর পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে দেখা যায়, ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মধ্যে দুটি গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের বিবাদ এই আত্মহত্যার ঘটনার নেপথ্যে থাকতে পারে। ডেপুটি কমিশনার কালাগদি বলেন,
“দুই গোষ্ঠীর মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে দীর্ঘদিনের রেষারেষি ছিল। এক গোষ্ঠীর নেতার বিরুদ্ধে অন্যদের হেনস্তা ও অপমানের অভিযোগ রয়েছে। আমরা তাদের বক্তব্য নিচ্ছি এবং ঘটনার পূর্ণ তদন্ত চলছে।”

পুলিশ ইতিমধ্যে এই ঘটনায় একটি এফআইআর দায়ের করেছে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

অন্য দিকের গল্প: যৌন হেনস্তা ও ব্ল্যাকমেলের অভিযোগ

তবে ঘটনার আরও গভীরে গেলে উঠে আসে আরও ভয়ঙ্কর চিত্র। স্থানীয় সম্প্রদায়ের এক নেত্রী নেহা কুনওয়ার জানান, আত্মহত্যার চেষ্টার পেছনে রয়েছে এক ভয়াবহ যৌন হেনস্তার ঘটনা। তাঁর দাবি, সম্প্রতি দুজন ব্যক্তি সাংবাদিক পরিচয়ে এক ট্রান্সজেন্ডার নারীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা তাঁকে ধর্ষণ, ব্ল্যাকমেল এবং ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করেন।

ভুক্তভোগী তিন মাস আগে এই ঘটনা পুলিশের কাছে জানান এবং পরে একটি এফআইআর নথিভুক্ত হয়। কুনওয়ারের বক্তব্য অনুযায়ী, “আমরা কি মানুষ নই? কেন আমাদের কথা কেউ শোনে না? অভিযুক্তরা ভুক্তভোগীর কাছ থেকে দেড় লাখ রুপি লুট করে নিয়েছে, অথচ ন্যায়বিচার পাইনি।”

এই অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার রাজেশ দান্ডোতিয়া। তিনি বলেন, অভিযুক্তদের নাম অক্ষয় ও পঙ্কজ। তাঁরা ১২ জুন ওই ট্রান্সজেন্ডার নারীর ওপর নির্যাতন চালান এবং ভিডিও ধারণ করে তাঁকে ব্ল্যাকমেল করেন।

পুলিশের অবস্থান: দুটি আলাদা ঘটনা

তবে পুলিশের দাবি, গণ আত্মহত্যার চেষ্টা এবং যৌন হেনস্তার ঘটনা দুটি আলাদা বিষয়। তদন্তে এই দুটি ঘটনার মধ্যে সরাসরি কোনো সম্পর্ক এখনো পাওয়া যায়নি। রাজেশ দান্ডোতিয়া জানান,
“আমরা দুটি ঘটনাকেই আলাদা করে দেখছি। আত্মহত্যার প্রচেষ্টা গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের ফল হতে পারে, তবে যৌন হেনস্তার মামলাটিও গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে।”

সমাজে ট্রান্সজেন্ডারদের অবহেলা ও মানসিক চাপ

ভারতে ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায় বা হিজড়া সমাজ বহুদিন ধরে বৈষম্য, কটূক্তি, এবং সামাজিক অবহেলার শিকার হয়ে আসছে। আইনগতভাবে ২০১৯ সালে “ট্রান্সজেন্ডার পারসনস প্রোটেকশন অব রাইটস অ্যাক্ট” পাস হলেও বাস্তবে তাঁদের জীবনে পরিবর্তন আসেনি তেমনভাবে।

ইন্দোরের সমাজবিজ্ঞানী ড. অর্পিতা চৌধুরী বলেন,
“ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা সামাজিকভাবে বঞ্চিত, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, এবং আর্থিকভাবে অনিশ্চিত জীবনে বাস করেন। তাঁদের মধ্যে মানসিক চাপ, হতাশা এবং আত্মসম্মানহানির অনুভূতি অত্যন্ত বেশি। এই ঘটনা সেই দীর্ঘদিনের অবহেলার ফল।”

ভারতের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন জানিয়েছে, ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের প্রতি সহিংসতা, ব্ল্যাকমেল এবং যৌন নির্যাতনের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। অধিকাংশ সময় এ ধরনের ঘটনার বিচার হয় না।

স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া: “তারা শুধু সম্মান চায়”

ইন্দোরের নন্দলালপুরা এলাকার স্থানীয় এক ব্যবসায়ী জানান, “ওরা অনেক বছর ধরে এখানে থাকে। কারও ক্ষতি করে না। কিন্তু সমাজ এখনো ওদের মানুষ হিসেবে মেনে নিতে চায় না।”

আরেকজন বাসিন্দা বলেন, “ওদের অনেক সময় অপমান করা হয়, দোকানে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। পুলিশের প্রতিও ওদের আস্থা কম। তাই হয়তো এত বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।”

মানবাধিকার কর্মীদের দাবি – দ্রুত তদন্ত ও পুনর্বাসন প্রয়োজন

ভারতের মানবাধিকার সংগঠন ন্যাশনাল ট্রান্সজেন্ডার কাউন্সিল এই ঘটনার কঠোর নিন্দা জানিয়েছে। সংগঠনের সভাপতি প্রীতি রাও বলেন,
“এটি কেবল একটি আত্মহত্যার ঘটনা নয়, বরং এটি সমাজের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। সরকারকে এখনই মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, পুনর্বাসন কেন্দ্র, এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার উদ্যোগ নিতে হবে।”

তাঁর মতে, “এই ২৪ জন সৌভাগ্যবশত বেঁচে গেছেন। কিন্তু প্রতিদিন হাজারো ট্রান্সজেন্ডার মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন। এখনই যদি পরিবর্তন না আসে, আরও বড় ট্র্যাজেডি ঘটবে।”

সরকারি প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ

মধ্যপ্রদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ দপ্তর ইতিমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির একজন কর্মকর্তা জানান,
“আমরা ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের সমস্যাগুলো জানার চেষ্টা করছি। তাঁদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে।”

এছাড়া, ইন্দোর পৌরসভা জানিয়েছে, তারা স্থানীয় হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ কল্যাণ প্রকল্প চালু করার কথা ভাবছে যাতে তাঁদের জীবনমান উন্নত হয়।

ভারতে ট্রান্সজেন্ডারদের অবস্থা – কিছু পরিসংখ্যান

ভারতের ২০১১ সালের জনগণনায় ট্রান্সজেন্ডার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪.৮ লাখ। তবে বেসরকারি সংস্থাগুলোর মতে, প্রকৃত সংখ্যা এর দ্বিগুণেরও বেশি।

  • ৭০ শতাংশ ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি শিক্ষার সুযোগ পান না
  • প্রায় ৬৫ শতাংশকে পরিবার থেকে বের করে দেওয়া হয়
  • ৮০ শতাংশ ট্রান্সজেন্ডার কোনো না কোনোভাবে যৌন হেনস্তার শিকার

এই পরিস্থিতি শুধু সামাজিক অবহেলার নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নীতির দুর্বলতারও প্রতিফলন।

মনোবিজ্ঞানীদের মত – “তাদের পাশে দাঁড়ানোই একমাত্র সমাধান”

মনোবিজ্ঞানী ড. অনিতা দেশমুখ বলেন,
“যে কেউ দীর্ঘদিন অপমান, বৈষম্য ও একাকীত্বের মধ্যে থাকে, তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ট্রান্সজেন্ডারদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও জটিল, কারণ সমাজ তাদের মানুষ হিসেবেও স্বীকৃতি দিতে চায় না। এই অবস্থায় তারা আত্মহত্যাকে মুক্তির পথ হিসেবে দেখে।”

তিনি পরামর্শ দেন, “সরকারি হাসপাতালে আলাদা কাউন্সেলিং ইউনিট স্থাপন করা উচিত, যেখানে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা ভয় ছাড়া কথা বলতে পারেন।”

MAH – 13361 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button