
ডেঙ্গু আতঙ্কে মশার কয়েলের ব্যবহার বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, কয়েলের ধোঁয়া মশা তাড়ানোর পাশাপাশি ফুসফুসে ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। নিরাপদ বিকল্প হিসেবে তারা মশারি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন।
রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকার নিয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এই আতঙ্কে সাধারণ মানুষ রাত কাটাচ্ছে মশা তাড়ানোর নানা উপায়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে মশার কয়েল। তবে চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন— কয়েল জ্বালানো সাময়িকভাবে মশা দূর করলেও এর ধোঁয়া মানুষের শরীরে প্রবল ক্ষতি ডেকে আনছে।
মশার কয়েল: সাময়িক স্বস্তি, স্থায়ী ক্ষতি
শহরের ছোট দোকান থেকে শুরু করে বড় সুপারশপ— সর্বত্র সহজলভ্য মশার কয়েল। দামও তুলনামূলক কম হওয়ায় নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো নিয়মিত এটি ব্যবহার করছে। অনেক কয়েল ২৪ ঘণ্টা বা ৭২ ঘণ্টা সুরক্ষা দেয়ার দাবি করলেও বাস্তবে তা শতভাগ কার্যকর নয়।
রাতভর কয়েলের ধোঁয়া শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করলে শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, চোখ জ্বালা ও অ্যালার্জির মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এটি ফুসফুসে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।
ডেঙ্গু আতঙ্কে বাড়ছে ব্যবহার
বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুম এলেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। এ বছরও ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড ছুঁয়েছে। প্রতিদিন সংবাদ শিরোনামে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্রাণহানি। ফলে মানুষ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কয়েল ব্যবহার করছে বেশি।
কিন্তু চিকিৎসকেরা বলছেন, কয়েল ব্যবহারে ডেঙ্গুর ঝুঁকি কমে না। বরং ধোঁয়ার ক্ষতিকর প্রভাব রোগীদের অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলছে। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীদের অনেকেই জানিয়েছেন, কয়েল ব্যবহার করেও তারা মশা থেকে রক্ষা পাননি।
স্বাস্থ্যঝুঁকি: কী বলছেন চিকিৎসকরা
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম জানান, কয়েলের ধোঁয়ায় বিষাক্ত গ্যাস থাকে, যা শ্বাসনালীর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে। তিনি বলেন, “মশার প্রকোপ থেকে বাঁচতে গিয়ে অনেকেই বুঝতে না পেরে নিজেদের ফুসফুস ধ্বংস করছেন।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, কয়েলের ধোঁয়া দীর্ঘ সময় শ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি হয়। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এটি মারাত্মক। এছাড়া হাঁপানি বা অ্যাজমার রোগীদের অবস্থাও আরও খারাপ হতে পারে।
পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, একটি কয়েল জ্বালালে যে পরিমাণ ধোঁয়া তৈরি হয়, তা প্রায় ১০০টির বেশি সিগারেট ধূমপানের সমতুল্য ক্ষতি করতে পারে। অর্থাৎ প্রতিদিন কয়েলের ধোঁয়া গ্রহণ করা মানে ধীরে ধীরে শরীরে বিষ জমা করা।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাধিক স্বাস্থ্য সংস্থা কয়েলের অতিরিক্ত ব্যবহারকে ‘নীরব ঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
বিকল্প ও প্রতিরোধের উপায়
চিকিৎসকরা মশার কয়েলের পরিবর্তে নিরাপদ ও কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে মশারি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। মশারি শতভাগ সুরক্ষা দেয় এবং এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
এছাড়া বাসার চারপাশ পরিষ্কার রাখা, জমে থাকা পানি অপসারণ করা এবং এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার ওপর গুরুত্ব দিতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রয়োজনে নিরাপদ রিপেলেন্ট বা বৈদ্যুতিক মশা নিধন যন্ত্র ব্যবহার করার পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত ও নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কয়েলের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে সরকারকে কঠোর নীতি গ্রহণ করতে হবে। উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে কড়াকড়ি নজরদারি জরুরি। একইসঙ্গে জনগণকে সচেতন করতে গণমাধ্যমে প্রচারণা বাড়ানো দরকার।
একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, “ডেঙ্গুর ভয়াবহতা ঠেকাতে জনগণকে নিরাপদ বিকল্প বেছে নিতে হবে। কয়েল কোনো সমাধান নয়, বরং নতুন বিপদ ডেকে আনে।”
ডেঙ্গুর আতঙ্কে মশার কয়েল ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। কিন্তু এটি সাময়িক সান্ত্বনা দিলেও দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। তাই এখনই সচেতন হতে হবে— নিজের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে কয়েল নয়, বরং মশারি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ গড়ে তোলার দিকে মনোযোগী হওয়া জরুরি।
এম আর এম – ১৪৯৬,Signalbd.com