একই রানি পিঁপড়া দুই ভিন্ন প্রজাতির সন্তান জন্ম দিতে পারে

প্রাণিজগতের জগৎ সর্বদা রহস্যময়, আর এবার সেই রহস্য আরও একবার চমকপ্রদ প্রমাণ দেখিয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, স্পেনের আইবেরিয়ান হারভেস্টার পিঁপড়ার রানি একসঙ্গে দুই ভিন্ন প্রজাতির পিঁপড়া জন্ম দিতে সক্ষম। এই অদ্ভুত প্রজনন ক্ষমতার প্রমাণ পেলেন ফ্রান্সের মন্টপেলিয়ারের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র গবেষক জোনাথান রোমিগুয়ো এবং তার দল।
গবেষণাটি ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সালে ‘নেচার’ সাময়িকী-তে প্রকাশিত হয়েছে, যা পিঁপড়ার প্রজনন জগতকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।
আইবেরিয়ান হারভেস্টার ও মেসর স্ট্রাক্টর: দুটি প্রজাতির মিলন
গবেষণার সূত্রপাত হয়েছিল ইতালির সিসিলি দ্বীপে। এখানে একটি আইবেরিয়ান হারভেস্টার কলোনিতে হঠাৎ করে দেখা যায় পরিচিত মেসর স্ট্রাক্টর প্রজাতির কিছু পিঁপড়া অনুপস্থিত। তবে কলোনির কাজকর্ম—যেমন খাবার সংগ্রহ, বাসা গঠন ইত্যাদি—চলছিল স্বাভাবিকভাবে।
গবেষক রোমিগুয়ো জানান, “আমাদের দৃঢ় সন্দেহ ছিল যে এই প্রজাতি কোনো অস্বাভাবিক প্রজনন কৌশল ব্যবহার করছে। তবে এর চমকপ্রদ মাত্রা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি।”
পরবর্তী গবেষণায়, ইউরোপ জুড়ে ১২০টিরও বেশি কলোনি বিশ্লেষণ করা হয় এবং শত শত পিঁপড়ার জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন হয়। দুই বছরের ল্যাব পরীক্ষার পর দেখা যায়—একই রানির ডিম থেকে জন্ম নেয় একদিকে লোমশ আইবেরিয়ান হারভেস্টার, অন্যদিকে প্রায় নির্লোম মেসর স্ট্রাক্টর প্রজাতির পিঁপড়া।
এক রানি, দুই প্রজাতির সন্তান
গবেষণার ভিত্তিতে দেখা গেছে, মেসর আইবেরিয়ান হারভেস্টার রানির ডিম দুটি ভিন্নভাবে বিকাশ লাভ করে।
- রানির ডিম থেকে বিশুদ্ধ মেসর আইবেরিয়ান হারভেস্টার জন্ম হয়, যখন ভবিষ্যতে নতুন রানির প্রয়োজন হয়।
- কর্মী পিঁপড়ার জন্য ডিমে মেসর স্ট্রাক্টরের শুক্রাণু যুক্ত হয়ে জন্ম নেয় হাইব্রিড প্রজাতি, যা কলোনির প্রায় ৯৯% অংশ গঠন করে।
গবেষকরা ব্যাখ্যা করেন, এটি পিঁপড়ার প্রজনন সম্পর্কে পূর্বধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে, কারণ প্রথাগতভাবে এক রানি শুধুমাত্র নিজের প্রজাতির সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করা হতো।
ক্লোনিং ও ‘সেক্সুয়াল ডমেস্টিকেশন’
মেসর আইবেরিয়ান হারভেস্টার রানিরা এক সময়ে নিজেদের কর্মী তৈরি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তাই তারা মেসর স্ট্রাক্টর পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে হাইব্রিড কর্মী তৈরি করতে শুরু করে।
গবেষকরা এটিকে সেক্সুয়াল ডমেস্টিকেশন (sexual domestication) বলে অভিহিত করেছেন। এর মানে হলো, মানুষ যেভাবে গৃহপালিত পশু নিয়ন্ত্রণ করে, ঠিক সেইভাবে রানিরা বন্য পুরুষ পিঁপড়ার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে।
এভাবে তারা তাদের কলোনিতে মেসর স্ট্রাক্টরের পুরুষ ক্লোন তৈরি করে, যার জন্য আর ভৌগোলিকভাবে ওই প্রজাতির কাছে থাকা প্রয়োজন হয় না। এর ফলে ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন অঞ্চলে লাখ লাখ হাইব্রিড কলোনি গড়ে উঠেছে।
জেনানারা (Xenoparous) প্রজনন: নতুন কৌশল
গবেষকরা এই কৌশলকে নাম দিয়েছেন ‘জেনানারা’ (xenoparous) প্রজনন, যার অর্থ ‘ভিন্ন প্রজাতির জন্মদানকারী’।
এ ধরনের প্রজনন কৌশলে, এক প্রজাতি নিজের ডিম ব্যবহার করে অন্য প্রজাতির জিন ছড়িয়ে দেয়, এবং শুধুমাত্র রানিরা বিশুদ্ধ থাকে। কর্মী পিঁপড়ারা হয় হাইব্রিড, যাদের মধ্যে মেসর স্ট্রাক্টরের শুক্রাণুর প্রভাব বেশি।
মাতৃ জিন মুছে দিয়ে পিতার ক্লোন তৈরি
সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, রানিরা নিজের নিউক্লিয়ার ডিএনএ সম্পূর্ণ মুছে দেয় এবং শুধুমাত্র পুরুষের শুক্রাণুর জিন দিয়ে ডিম থেকে সন্তান তৈরি করে।
ফলাফল: জন্ম হয় প্রায় নিখুঁত ক্লোন, যা পিতার মতো দেখতে। যদিও ক্লোন পুরুষের মাইটোকন্ড্রিয়ায় রানির ডিএনএ-এর একটি ক্ষুদ্র অংশ (প্রায় ০.১%) থাকে, নিউক্লিয়ার জিনোম অনুযায়ী তারা প্রকৃত ক্লোন হিসাবেই গণ্য হয়।
পরীক্ষাগারে দুই বছরের পর্যবেক্ষণের পর দেখা গেছে, একই রানির ডিম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনোমযুক্ত দুই প্রজাতির পুরুষ জন্ম নেয়—মেসর স্ট্রাক্টর পুরুষ নির্লোম, আর মেসর আইবেরিয়ান হারভেস্টার পুরুষ লোমশ।
বৈজ্ঞানিক ও ভবিষ্যত গবেষণার সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধরনের ক্লোনিং ভবিষ্যতে অন্যান্য প্রজাতির কৃত্রিম ক্লোনিংয়ে সহায়ক হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এই পদ্ধতি টিকে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে সংশয়ও রয়েছে।
ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক জ্যাকোবাস বুমস্মা বলেন, “একই জিন বারবার ক্লোন করা হলে বিবর্তনীয় বৈচিত্র্য হারিয়ে যায়, যা প্রজাতির বিলুপ্তির ঝুঁকি বাড়ায়।”
ক্যালিফোর্নিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের জেসিকা পার্সেল বলেন, “পিঁপড়াদের মধ্যে এমন অদ্ভুত প্রজনন কৌশল আগে দেখা যায়নি। এটি শুধু বিজ্ঞান নয়, প্রকৃতির জটিলতারও এক অপূর্ব নিদর্শন।”
প্রাকৃতিক জটিলতা ও বৈজ্ঞানিক বিস্ময়
এই গবেষণা প্রমাণ করে যে, প্রকৃতি এখনও বহু রহস্য লুকিয়ে রেখেছে। এক রানি পিঁপড়া, যিনি দুই ভিন্ন প্রজাতির সন্তান জন্ম দিতে পারেন, তা কেবল জীববিজ্ঞানীদের জন্য নয়, সাধারণ পাঠকের জন্যও বিস্ময়কর।
এটি প্রাকৃতিক বিবর্তন, হাইব্রিডাইজেশন এবং ক্লোনিং-এর এক অনন্য উদাহরণ, যা আমাদের শেখায়—প্রকৃতির জটিলতা কখনো সীমিত নয়।
গবেষণাটি ভবিষ্যতে জৈববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, কৃত্রিম প্রজনন কৌশল এবং ক্লোনিং গবেষণায় নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারে। পিঁপড়াদের এই অনন্য কৌশল মানবজীবন ও জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও নতুন প্রেরণা যোগাবে।
MAH – 12844 Signalbd.com