কবরে মৃতদেহ অক্ষত থাকা কি নেককার হওয়ার আলামত?

মানুষের মৃত্যু হলো জীবনের অবশ্যম্ভাবী সত্য। মৃত্যুর পর দেহ মাটিতে সমাহিত করা হয়, এবং তারপর যে কোন ব্যক্তি কেমনভাবে আল্লাহর বিচার পাবে, তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। তবে কখনো কখনো বহুদিন পর কেউ মৃতদেহ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেলে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও কৌতূহল সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে, অনেকেই মনে করেন, মৃতদেহ অক্ষত থাকা মানে সেই ব্যক্তি নেককার বা আল্লাহর বিশেষ বান্দা।
কোরআন ও হাদিসে মৃতদেহ সংক্রান্ত নির্দেশনা
ইসলামে মৃতদেহের পচন, অক্ষত থাকা বা দেহ সংরক্ষণের বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছা এবং প্রাকৃতিক কারণে নির্ধারিত। হাদিসে বর্ণিত আছে, নবী-রাসুলগণের দেহকে আল্লাহ মাটির জন্য হারাম করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মহান আল্লাহ নাবী-রাসুলদের দেহকে মাটিতে নষ্ট হতে দেননি (আবু দাউদ, হাদিস: ১০৪৭)।
তবে, মুসলিমরা সচেতন হবেন যে, কবরে মৃতদেহ অক্ষত পাওয়া মানেই ওই ব্যক্তি নেককার বা জান্নাতপ্রাপ্ত—এটি নিশ্চিত প্রমাণ নয়। ইসলামী শিক্ষায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর আল্লাহর বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে, “আমি মাটি থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছি, তাতেই তোমাদের ফিরিয়ে দেব এবং তা থেকে পুনর্বার তোমাদের বের করব” (সুরা তাহা, আয়াত ৫৫)। অর্থাৎ, দেহ পচে যাওয়া বা অক্ষত থাকা উভয়ই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার অংশ।
অক্ষত দেহের বাস্তব কারণ
বিভিন্ন সময়ে কিছু সাহাবায়ে কেরাম বা নেককার মনীষীর দেহ বহু বছর পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এছাড়া প্রাকৃতিক কারণ বা দাফনের পদ্ধতি থেকেও দেহ দীর্ঘসময় অক্ষত থাকতে পারে।
ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা জানান, মৃত্যুর কিছু মিনিটের মধ্যেই পচন প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে এর সময়কাল পরিবেশ, তাপমাত্রা, মাটির ধরনের অম্লতা এবং কফিনের উপাদানের উপর নির্ভর করে। সাধারণ কফিনে দাফন করা দেহ প্রায় এক বছরের মধ্যে পচন শুরু করে, পুরোপুরি কঙ্কাল হওয়ার সময় লাগে প্রায় এক দশক।
অতএব, দেহের অক্ষত থাকা শুধুমাত্র নেককার হওয়ার আলামত হিসেবে দেখা সঠিক নয়।
ইতিহাসে অক্ষত দেহের নজির
পৃথিবীতে বহু উদাহরণ আছে, যেখানে নেককার বা বিশেষ বান্দাদের দেহ বহু বছর অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। আবার কখনো প্রাকৃতিক কারণে দেহ দীর্ঘদিন অক্ষত থাকে। যেমন, কোরআনে ফেরাউনের দেহ অক্ষত রাখার প্রসঙ্গ উল্লেখ আছে (সুরা ইউনুস, আয়াত ৯২), যা নিদর্শন স্বরূপ।
এ থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ ইচ্ছা করলে দেহ অক্ষত রাখেন। তবে এই বিষয়টি দিয়ে কোনো ব্যক্তির নেককারি বা পাপ-মুক্তি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞ ও ধর্মীয় মতামত
ইসলামী চিন্তাবিদরা মনে করেন, মৃতদেহ অক্ষত পাওয়া একটি অলৌকিক বা বৈজ্ঞানিক বিষয় হতে পারে, কিন্তু তা দিয়ে কাউকে জান্নাতি বা জাহান্নামি ধরা যায় না। মুসলিমরা শুধুমাত্র কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী নেককারি, পাপ ও জীবন পরিচালনার দিকে মনোযোগ দেবেন।
ধর্মবিশেষজ্ঞরা বলেন, “মৃত্যুর পর কে কেমন হবে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। মৃতদেহ অক্ষত থাকা বা পচে যাওয়া তা প্রমাণ করে না যে ব্যক্তি নেককার বা পাপী।”
সাধারণ পাঠকদের জন্য সতর্কতা
এই বিষয়ে গণমাধ্যমে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা গল্প ও ছবি প্রচলিত থাকে। অনেক সময় ভুল ব্যাখ্যা ও গুজবও ছড়ায়। তাই মুমিনদের উচিত:
- আল্লাহর ইচ্ছা ও কোরআন-হাদিস অনুসারে জীবন পরিচালনা করা।
- মৃতদেহের অবস্থা দেখে মানুষের নেককারি বা পাপ-মুক্তি নির্ধারণে বিশ্বাস না করা।
- মৃত্যুর পরের জীবন ও পরকালের বিষয়কে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেওয়া।
পরিশেষে
কবরে মৃতদেহ অক্ষত থাকা মানেই নেককার হওয়ার আলামত নয়। এটি প্রাকৃতিক কারণে বা আল্লাহর বিশেষ ইচ্ছার ফল হতে পারে। ইসলামী শিক্ষায় পরিষ্কার বলা আছে, মৃত্যুর পর আল্লাহর বিচার একমাত্র সত্য। তাই মানুষের উচিত মৃতদেহের অবস্থা নিয়ে গুজব না ছড়ানো এবং নিজের নেককারি ও পাপমুক্তি নিয়ে সচেতন থাকা।
মুমিনদের জন্য প্রধান শিক্ষা হলো, জীবনে নেককারি আমল করা এবং আল্লাহর বিধান মেনে চলা। মৃত্যুর পর আল্লাহর বিচারের জন্য অপেক্ষা করাই সর্বোত্তম পথ।
এম আর এম – ১৩২২,Signalbd.com