আজকের যুগে তরুণ-তরুণীরা প্রায়শই বন্ধু-বান্ধবদের সামনে রসিকতা বা মজার ছলে বিভিন্ন কথা বলে ফেলে। কিন্তু কখনো কখনো এই “ঠাট্টা” কথাও ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। সম্প্রতি কলেজ জীবনের এক ঘটনা মুসলিম সমাজে এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছে: দুষ্টুমির ছলে বিয়ে বলে ফেলা বৈধ হবে কি না?
ঘটনা সংক্ষেপ
একটি কলেজে এক বন্ধু তার বান্ধবীর সামনে মজা করে বলল, “আমি তোকে বিয়ে করলাম।”
মেয়েটিও মজা করে বলল, “আমি কবুল করলাম।”
এরপর তাদের মধ্যে আর কোনো কর্মকাণ্ড হয়নি। দু’জনই আলাদা আলাদা জায়গায় পড়াশোনা শেষ করে। পরে বন্ধু অন্যত্র বিয়ে করে, আর মেয়েটিরও বিয়ে ঠিক হয়েছে।
কিন্তু মেয়েটির বাবা এই ঘটনার কথা জানতে পেরে বলছেন, “তোমার বন্ধুর সঙ্গে তালাক নেওয়া দরকার।” বন্ধু অবশ্য বলছেন, “আমি তো মজা করে বলেছি।”
এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে:
- এই ইজাব-কবুল কি বৈধ বিয়ে হিসেবে গণ্য হবে?
- অন্যত্র মেয়েটিকে বিয়ে দিতে হলে তালাক নেওয়া আবশ্যক কি না?
ইসলামের দৃষ্টিকোণ: ইজাব-কবুলের গুরুত্ব
ইসলামে বিয়ে একটি গভীর ও পবিত্র সংস্থান, যা শুধু সমাজিক নয়, বরং ধর্মীয় দায়িত্বও বহন করে।
১. ইজাব-কবুল কি?
ইজাব হল বিয়ে প্রস্তাব, আর কবুল হল মেয়ের সম্মতি। মুসলিম শরীয়তে দুইজন সাক্ষীর সামনে ছেলে-মেয়ের সম্মতি থাকলেই বিয়ে বৈধ হয়।
২. ঠাট্টা ও দুষ্টুমি কি বৈধতা ভাঙে?
তিরমিযী শরীফে বর্ণিত আছে হযরত আবু হুরায়রা রা.-এর বর্ণনায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“তিনটি বিষয় এমন, যা স্বাভাবিকভাবে করলেও কার্যকর হয় এবং ঠাট্টাচ্ছলেও কার্যকর হয়:
১. নিকাহ
২. তালাক
৩. তালাক (রাজয়ী) দেওয়ার পর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়া।”
(জামে তিরমিযী, হাদিস ১১৮৪)
অর্থাৎ, সর্বোচ্চ সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও স্বাক্ষীদের সামনে ইজাব-কবুল হয়ে গেলে, এমনকি ঠাট্টা-দুষ্টুমির ছলে হলেও বিয়ে বৈধ হয়ে যেতে পারে।
বাস্তব পরিণতি
উপরের ঘটনার প্রেক্ষিতে:
- বন্ধু ও মেয়ের মধ্যে স্বাক্ষীর সামনে ইজাব-কবুল হয়েছে।
- কোনো যৌন সম্পর্ক হয়নি।
- তারা পৃথকভাবে বসবাস করেছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে:
- বিয়ে বৈধ হয়েছে।
- যদি মেয়েটিকে অন্যত্র বিয়ে দিতে চান, প্রথমে এই বিয়ে থেকে তালাক নেওয়া আবশ্যক।
- যেহেতু যৌন সম্পর্ক হয়নি, তাই ইদ্দতের প্রয়োজন নেই।
- তালাকের পর মেয়েটি অন্যত্র বিয়ে করতে পারবেন।
আইনি ও সামাজিক দিক
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, ইসলামিক শর্ত পূরণ হলে এই বিয়ে বৈধ। তাই এমন ঠাট্টা-কথাও সামাজিক ও আইনি জটিলতা ডেকে আনতে পারে।
সতর্কবার্তা:
- বিয়ে নিয়ে ঠাট্টা করা বা রসিকতা করা কখনোই ঠিক নয়।
- বেগানা ছেলেমেয়েদের অযথা দেখা-সাক্ষাৎ ও আড্ডা মারাত্মক গুনাহ হিসেবে বিবেচিত।
- শিক্ষার্থীদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞ মতামত
ইসলামিক ফাতাওয়া ও কিতাবগুলোর ভিত্তিতে:
| সূত্র | মন্তব্য |
|---|---|
| ফাতহুল কাদীর ৩/১১০ | ইজাব-কবুল দুইজন স্বাক্ষীর সামনে ঘটলে বিয়ে বৈধ |
| ফাতাওয়া খানিয়া ১/৩২৭ | মজা বা দুষ্টুমির ছলে হলেও বিয়ে কার্যকর |
| রদ্দুল মুহতার ৩/১১ | ইদ্দতের প্রয়োজন যৌন সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল |
| ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৪/১৩ | তালাক ছাড়া অন্যত্র বিয়ে দেয়া জায়েয নয় |
| মাজমাউল আনহুর ১/৪৬৯ | যুব সমাজকে সতর্ক থাকার পরামর্শ |
তরুণদের জন্য মূল শিক্ষা
- ঠাট্টা ও রসিকতায় বিয়ে নয়: এমন ঘটনা জীবনে জটিলতা তৈরি করতে পারে।
- স্বচ্ছতা ও সম্মতি: বিয়ে বা প্রস্তাব সর্বদা গম্ভীরভাবে ও সম্মতিপূর্ণভাবে করা উচিত।
- সাক্ষী থাকা অপরিহার্য: ইসলামিক বিয়েতে দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক।
- নিয়মিত ধর্মচর্চা: নামাজ, জাকাত ও নৈতিক শিক্ষা তরুণদের সঠিক পথ দেখায়।
ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিফলন
- ইসলাম শুধু আত্মিক নয়, সামাজিক জীবনেও প্রভাবশালী।
- ছোটখাটো রসিকতা সমাজে মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করতে পারে।
- কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সতর্ক থাকা যুব সমাজের দায়িত্ব।
দুষ্টুমির ছলে বলা “আমি তোকে বিয়ে করলাম” এবং “আমি কবুল করলাম” কেবল মজার জন্য হলেও, ধর্মীয় দৃষ্টিতে বৈধ হতে পারে।
তাই,
- মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিতে হলে তালাক নেওয়া আবশ্যক।
- যৌন সম্পর্ক না হলে ইদ্দত লাগবে না।
- ভবিষ্যতে এমন রসিকতা থেকে বিরত থাকা সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব।
সতর্কবার্তা: তরুণদের উচিত ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন এবং নৈতিকতার সঙ্গে চলা, যাতে এমন মজার ঘটনা জীবনে সমস্যার সৃষ্টি না করে।
MAH – 12312 , Signalbd.com



