ফ্যাক্ট চেক

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার বাড়ছে, কেন এই প্রবণতা?

Advertisement

 সম্প্রতি একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। প্রেমঘটিত সমস্যা, পারিবারিক চাপ, আর্থিক অনিশ্চয়তা ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলাই কি এ মৃত্যুমিছিলের পেছনে মূল কারণ? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই সময় সচেতন হওয়ার।

শিক্ষাজীবনের মাঝপথেই বিষাদের অবসান

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল থেকে anthropology বিভাগের শিক্ষার্থী সঞ্জু বরাইকের আত্মহত্যার খবরে আবারও হতবাক দেশবাসী। একই সঙ্গে সামনে এসেছে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা। গত আড়াই মাসে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন কমপক্ষে ৬ জন শিক্ষার্থী। তরুণদের এই মৃত্যুমিছিল এখন সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কী কারণে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা?

বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মহত্যার পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে:

১. পারিবারিক ও আর্থিক চাপ

ঢাকায় পড়তে আসা অনেক শিক্ষার্থীই নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। শহরের ব্যয়বহুল জীবন, বাড়িভাড়া, খাবার, শিক্ষা উপকরণ — এসব সামাল দিতে গিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন অনেকে। টিউশনি বা খণ্ডকালীন কাজ করে ব্যয় বহন করাও অনেক সময় সম্ভব হয় না। এতে জন্ম নেয় হতাশা ও হীনমন্যতা।

২. প্রেমঘটিত জটিলতা ও সম্পর্কের টানাপোড়েন

কৈশোর পেরিয়ে যে বয়সে মানুষ আত্মপরিচয় গড়ে তোলে, সে বয়সেই সম্পর্কের জটিলতা অনেক সময় বড় ধাক্কা দেয়। সম্পর্কে বিচ্ছেদ বা প্রত্যাখ্যান অনেক শিক্ষার্থীর মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়, যার পরিণতি হতে পারে আত্মহনন।

৩. মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে অবহেলা

‘অ্যান্টি সুইসাইডাল স্কোয়াড’-এর প্রতিষ্ঠাতা কাবিল সাদির মতে, “মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা আমাদের সমাজে এখনো গড়ে ওঠেনি। অধিকাংশ শিক্ষার্থী তাদের হতাশা কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারে না। একাকীত্ব ও অবসাদ থেকে জন্ম নেয় ভয়ংকর সিদ্ধান্ত।”

পরিসংখ্যান বলছে, বিপদ আরও গভীর

২০২১ সালে আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা যায়, গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্ণতার হার ৮৬% এবং শহরাঞ্চলে ৮৪%। স্ক্রিন টাইম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে দেখা গেছে, যারা দিনে ৩–৭ ঘণ্টা মোবাইল বা কম্পিউটারে তাকিয়ে থাকে, তাদের মধ্যে বিষণ্ণতার হার ৮৮%।

সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের সফলতা দেখে নিজেদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়ছে মানসিক চাপে। অনেক সময় পরিবারের পক্ষ থেকেও অযথা তুলনা ও চাপে হতাশা আরও বাড়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোতেও ঘাটতি?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. শান্তা তাওহিদা বলেন, “শুধু একাডেমিক ফলাফল নয়, শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতাও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও নিয়মিত কাউন্সেলিং থাকা জরুরি।” তিনি আরও বলেন, “মন খারাপও চিকিৎসার দাবি রাখে। যেকোনো আচরণগত পরিবর্তনে পরিবার, বন্ধু, সহপাঠীদের সচেতন হতে হবে।”

“মানসিক অসুস্থতা চোখে দেখা যায় না বলেই এটিকে অবহেলা করা হয়। অথচ সময়মতো সহযোগিতা পেলে অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব”—ড. শান্তা তাওহিদা, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষার্থীর জীবনে ‘অদৃশ্য যুদ্ধ’ চলছেই

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা নিঃসন্দেহে দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের অনেকেই পরিবারের একমাত্র ভরসা। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতিময় বয়সেই যদি কেউ নিজের জীবন শেষ করে দেয়, তবে বুঝতে হবে, কোথাও বড় ধরনের সামাজিক ঘাটতি রয়ে গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কার্যক্রম আরও জোরদার করা। একই সঙ্গে শিক্ষক, অভিভাবক, এবং বন্ধুবান্ধবদের সচেতন হতে হবে — কোন শিক্ষার্থী ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছে, তার দিকে সহানুভূতির চোখ রাখতে হবে।

এখনই সময় ব্যবস্থা নেওয়ার

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা নিছক একটি মর্মান্তিক ঘটনা নয় — বরং সমাজব্যবস্থা, শিক্ষা কাঠামো ও পরিবার-সংশ্লিষ্ট সংযোগ ব্যবস্থার গভীর অসুস্থতার প্রতিচ্ছবি। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, সম্পর্কের আন্তরিকতা এবং একে অপরকে সময় দেওয়াই হতে পারে এর একমাত্র প্রতিরোধ।

তবে প্রশ্ন থেকেই যায়:
আমরা কি এখনো সময়ের আগেই আমাদের তরুণদের হারাতে থাকব, নাকি এবার সত্যিই কিছু করব?

এম আর এম – ০৩৩৬, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button