
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর—দিনটি মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক ভয়াবহ দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেদিন ইসরাইলি দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে গাজার নিরীহ মানুষদের উপর শুরু হয় গণহত্যা, যা কয়েক মাস ধরে চলে এবং হাজারো শিশু, নারী ও বৃদ্ধকে অকালে প্রাণ দিতে হয়। আগামীকাল সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার দুই বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এই উপলক্ষে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোগ্রাফি ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান দৃক (Drik) আয়োজন করছে একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ কর্মসূচি।
এই আয়োজনে কণ্ঠ মিলবে শিল্পী, কবি, গীতিকার ও পারফরমারদের। মূল উদ্দেশ্য একটাই—ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সংগ্রামে কণ্ঠ দেওয়া এবং বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে গাজার গণহত্যা মানবতার বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ অপরাধ।
গাজার দুই বছরের ট্র্যাজেডি
ফিলিস্তিনে ইসরাইলি দমন-পীড়ন নতুন নয়। কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনি জনগণ দখল, নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে আসছে। তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর শুরু হওয়া গণহত্যা ছিল এর ভয়াবহতম দৃষ্টান্ত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানায়—
- কয়েক মাসের মধ্যে ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক ছিল শিশু।
- হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র ও মসজিদে বোমা হামলা চালানো হয়।
- পানি, বিদ্যুৎ ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যা ছিল আন্তর্জাতিক আইনের চোখে যুদ্ধাপরাধ।
- হাজার হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
জাতিসংঘ একাধিকবার এই হত্যাযজ্ঞকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে আখ্যায়িত করলেও এখনো কার্যকর কোনো বিচার হয়নি। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা গড়ালেও রাজনৈতিক স্বার্থে বিষয়টি ঝুলে আছে।
দৃকের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ
বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন সব সময় মানবিক ইস্যুতে ভূমিকা রেখেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ—প্রতিবারই গান, কবিতা, চিত্রকলা মানুষের চেতনা জাগিয়ে তুলেছে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াতে দৃক আয়োজন করেছে “ফিলিস্তিনের জন্য সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ” নামের অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানে থাকবে—
- গান: ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, অরূপ রাহী, মুয়ীজ মাহফুজ, সূচী মারমা, অর্জুন কর ও ‘সমগীত’ শিল্পীগোষ্ঠী।
- কবিতা পাঠ: ফেরদৌস আরা রুমী, রওশন আরা মুক্তা, রুম্মানা জান্নাত, মুনিমাহ মাহরিন, জাহিদ জগৎ, হাসান রোবায়েত, সৈকত আমীন ও তাহমীদ চৌধুরী।
- চিত্রকলা প্রদর্শনী: শিল্পী সুমন হালদার ও জান্নাতুল ইসলাম বিপার আঁকা গাজা ট্র্যাজেডি ও প্রতিরোধের ছবি।
দৃকের এই আয়োজনের মূল বার্তা— “ফিলিস্তিন মানে মানবতা, ফিলিস্তিন মানে ন্যায়বিচারের দাবি।”
সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ কেন জরুরি?
গান, কবিতা বা শিল্পকর্ম দিয়ে কি গণহত্যা ঠেকানো সম্ভব?—এমন প্রশ্ন অনেকের মনে জাগতে পারে। কিন্তু ইতিহাস বলে, সংস্কৃতিই মানুষের অন্তরে আন্দোলনের আগুন জ্বালায়।
- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন “আমার সোনার বাংলা” বা “জয় বাংলা বাংলার জয়” মানুষের মনোবল বাড়িয়েছে।
- দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে নেলসন ম্যান্ডেলার সংগ্রামে গান ছিল অন্যতম প্রেরণা।
- ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদে শিল্পী ও লেখকরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
অতএব, ফিলিস্তিনের মুক্তির লড়াইয়েও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ একটি শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।
গাজার শিশুদের কান্না: মানবতার কাছে প্রশ্ন
গাজার গণহত্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিশু। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যমতে—
- প্রতিদিন গড়ে ১৫০-২০০ শিশু নিহত হয়েছিল।
- অনেকে অঙ্গহানি হয়ে আজীবন পঙ্গু হয়ে গেছে।
- যুদ্ধ শেষে হাজারো শিশু এতিম হয়ে আশ্রয়হীন জীবন কাটাচ্ছে।
এই শিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত প্রজন্ম হয়তো বড় হয়ে আরও ক্ষোভে ফেটে পড়বে, যা ভবিষ্যৎ বিশ্ব শান্তির জন্য বড় হুমকি হতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ব্যর্থতা
বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ইসরাইলের গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছিল। আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া—সবখানেই লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তবে দুঃখজনক হলো, বড় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান অনেকাংশে ইসরাইলের পক্ষেই থেকেছে।
- জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বারবার ভেটো হয়।
- পশ্চিমা মিডিয়ার একটি অংশ গাজার গণহত্যাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছে।
- মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়াও অনেকটাই বিভক্ত ছিল।
এই ব্যর্থতা প্রমাণ করে, এখনো বিশ্ব রাজনীতি মানবতার চেয়ে ক্ষমতা ও স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেয়।
বাংলাদেশে ফিলিস্তিন-সমর্থন
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকেই ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে বর্তমান সরকার—সবাই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলাদেশের জনগণও সবসময় ফিলিস্তিনের পাশে থেকেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সাধারণ মানুষ প্রায়ই ফিলিস্তিনের পক্ষে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও দোয়া মাহফিল আয়োজন করে। দৃকের এবারের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ সেই জনমতেরই ধারাবাহিকতা।
সাংবাদিক ও শিল্পীদের দায়বদ্ধতা
যুদ্ধ শুধু রণক্ষেত্রেই লড়া হয় না, লড়া হয় তথ্যের ময়দানেও। ইসরাইলের প্রচারণা যন্ত্র বিশ্বে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণে ব্যস্ত। তাই সাংবাদিক, লেখক ও শিল্পীদের দায়িত্ব—
- সত্য তুলে ধরা
- নির্যাতনের ছবি বিশ্ববাসীর সামনে আনা
- গণহত্যার স্মৃতি ধরে রাখা
- নতুন প্রজন্মকে সচেতন করা
দৃকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এই কাজই করে যাচ্ছে বছরের পর বছর।
গাজার গণহত্যার দুই বছর পূর্তিতে দৃকের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়; এটি মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা। ফিলিস্তিনের শিশুদের রক্ত, মায়ের আহাজারি আর বিধ্বস্ত শহরের ভগ্নচিত্র বিশ্বকে মনে করিয়ে দিচ্ছে—ন্যায়বিচার ছাড়া শান্তি অসম্ভব।
আজ যখন বিশ্বরাজনীতি অমানবিক হয়ে উঠেছে, তখন গান, কবিতা আর শিল্পই মানুষকে সত্যের পথে জাগিয়ে তুলতে পারে। তাই এই প্রতিরোধ শুধু ফিলিস্তিনের নয়, এটি প্রতিটি ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো মানুষের প্রতিরোধ।
MAH – 13196 I Signalbd.com