বিনোদন

গোপালগঞ্জে কুমার নদে জমজমাট নৌকাবাইচ

Advertisement

ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মিলনমেলার এক অনন্য আয়োজন

গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার হোগলাকান্দি গ্রামে কুমার নদকে ঘিরে আয়োজন করা হয়েছিল দুই দিনব্যাপী নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। শুক্রবার বিকেলে এই প্রতিযোগিতার সমাপনী দিনে নদীর দুই তীর ভরে ওঠে হাজারো দর্শকের উল্লাসে। গ্রামীণ জীবনের প্রাণচাঞ্চল্য, ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া ও মিলনমেলার উচ্ছ্বাসে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।

হাজারো মানুষের ভিড়, উল্লাস আর করতালি

গতকাল দুপুর থেকে নদীর দুই পাড়ে ভিড় জমতে শুরু করে দর্শকদের। বয়স্ক, যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে ছোট শিশুরাও আনন্দে মেতে ওঠে। যখন মাঝিরা বৈঠা চালিয়ে দ্রুতগতিতে নৌকাকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন, তখন দর্শকেরা করতালি, ঢাক-ঢোল আর স্লোগানে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। তরুণ-তরুণীরা মোবাইল ফোনে প্রতিটি মুহূর্ত ধারণ করে রাখছিলেন।

নৌকাবাইচের উত্তেজনায় যেন সবাই একাত্ম হয়ে যায়। কেউ ছিলেন দর্শক, কেউ আবার ছিলেন নৌকার মাঝি—তবে সবার উদ্দেশ্য ছিল একটাই, ঐতিহ্যকে ধরে রাখা আর আনন্দ ভাগাভাগি করা।

প্রতিযোগিতার ফলাফল

এবারের নৌকাবাইচে মোট ছয়টি দল অংশ নেয়। প্রতিযোগিতার ফাইনালে ‘যুব এক্সপ্রেস’ নামের নৌকাটি প্রথম স্থান অর্জন করে।

আয়োজক কমিটির প্রধান গিয়াস উদ্দিন জানান, শুধু প্রতিযোগিতা নয়, গ্রামের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধরে রাখা, নতুন প্রজন্মকে শিকড়ের সঙ্গে পরিচয় করানো এবং সাধারণ মানুষকে বিনোদন দেওয়াই ছিল এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য।

অতিথিদের উপস্থিতি

সমাপনী দিনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম। তিনি বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন এবং বলেন, “গ্রামীণ জীবনের ঐতিহ্য ধরে রাখতে ও মানুষে-মানুষে সম্প্রীতি বজায় রাখতে নৌকাবাইচের মতো আয়োজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

এছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পলাশ কুমার দেবনাথ, উপজেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম মোস্তফা মোল্যা, যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-শ্রমবিষয়ক সম্পাদক মঈনুল ইসলাম, সহ-সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুল হাসানসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।

দর্শকদের আনন্দ

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা থেকে পরিবার নিয়ে নৌকাবাইচ দেখতে আসেন ইকবাল চৌধুরী। তিনি বলেন, “প্রতিবছর আমরা এই প্রতিযোগিতার অপেক্ষায় থাকি। শুধু নৌকাবাইচ নয়, মেলার আয়োজনও আমাদের কাছে বড় আনন্দের উৎস।”

দশম শ্রেণির ছাত্রী ফাতেমা আক্তার জানায়, “নৌকাবাইচের সাথে মেলার আনন্দটাও ভীষণ উপভোগ করেছি। মাটির তৈরি সামগ্রী কিনেছি, নাগরদোলায় চড়েছি, আবার মিষ্টির দোকান থেকেও অনেক কিছু খেয়েছি।”

ঐতিহ্যের শিকড়: নৌকাবাইচের ইতিহাস

বাংলাদেশের নদীমাতৃক জীবনের সঙ্গে নৌকাবাইচ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। গ্রামীণ জনপদের উৎসব-আনন্দের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হলো এই প্রতিযোগিতা। শত বছর আগে থেকেই বর্ষাকাল শেষে বা শরৎকালে নৌকাবাইচ আয়োজন করা হতো। একসময় এটি ছিল কেবল ক্রীড়া নয়, বরং সামাজিক ঐক্য ও শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যম।

ইতিহাসবিদদের মতে, নৌকাবাইচ প্রথম জনপ্রিয়তা পায় বাংলার জমিদার আমলে। জমিদাররা তাদের প্রভাব বিস্তারের অংশ হিসেবে নৌকার দল বানিয়ে প্রতিযোগিতা আয়োজন করতেন। পরবর্তীতে এটি সাধারণ মানুষের উৎসব হয়ে ওঠে। এখনো গ্রামীণ এলাকায় বর্ষা ও শরৎকালের সবচেয়ে বড় আনন্দ-উৎসব হিসেবে নৌকাবাইচকে ধরা হয়।

নৌকাবাইচের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

নৌকাবাইচ শুধু একটি ক্রীড়া নয়—এটি গ্রামীণ জীবনের আবেগ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতীক। বৈঠার ছন্দে মাঝিদের কণ্ঠধ্বনি, ঢাক-ঢোলের তালে দর্শকদের করতালি—সব মিলিয়ে এটি পরিণত হয় এক বিশাল উৎসবে।

গ্রামীণ সমাজে নৌকাবাইচ মানে কেবল প্রতিযোগিতা নয়, বরং পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবার মিলনমেলা। একসাথে আনন্দ করার, দেখা হওয়ার ও স্মৃতি তৈরি করার দিন এটি।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব

নৌকাবাইচকে ঘিরে হোগলাকান্দি গ্রামে বসে গ্রামীণ মেলা। এখানে পাওয়া যায় স্থানীয় কৃষিপণ্য, হস্তশিল্প, মাটির তৈরি জিনিসপত্র, খেলনা, মিষ্টি ও নানা ধরনের খাবার। এতে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হন, তেমনি গ্রামের মানুষের জন্য এটি হয়ে ওঠে কেনাকাটার এক বিশেষ সুযোগ।

এছাড়া এই ধরনের আয়োজন সামাজিক সম্প্রীতি ও ঐক্য বৃদ্ধি করে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে মানুষ সবাই একসাথে আনন্দে মেতে ওঠে।

আধুনিক যুগে নৌকাবাইচ

প্রযুক্তির যুগেও নৌকাবাইচের জনপ্রিয়তা কমেনি। বরং এখন এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ছে। দর্শকেরা মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করছেন। ফলে শুধু স্থানীয় মানুষ নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষও এই আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারছেন।

সরকারের উদ্যোগ ও সম্ভাবনা

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সঠিক উদ্যোগ নিলে নৌকাবাইচ পর্যটন শিল্পের বড় সম্পদ হতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় যদি নিয়মিত আয়োজন করা হয়, তবে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আকৃষ্ট হবেন। এতে স্থানীয় অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।

গোপালগঞ্জের কুমার নদে অনুষ্ঠিত এ নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা শুধু একটি ক্রীড়া নয়, বরং গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রাণবন্ত উৎসব। এটি মানুষকে শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত রাখে, ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখে এবং সমাজে সম্প্রীতি ও আনন্দ ছড়িয়ে দেয়।

MAH – 12910 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button