ত্রাণ চাই না, ভাত চাই না, টেকসই বেড়িবাঁধ চাই

খুলনা অঞ্চলের উপকূলজুড়ে আবারও দেখা দিয়েছে নদী ভাঙনের আতঙ্ক। বিশেষ করে পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দেওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা। নদী পাড়ের হাজারো মানুষ মঙ্গলবার দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল করে দাবি জানান, তারা আর অস্থায়ী প্রতিশ্রুতি চান না, এখন তাদের প্রয়োজন একটি টেকসই বেড়িবাঁধ।
স্থানীয়দের দাবিতে বিক্ষোভ
দেলুটি ইউনিয়নের কালিনগরসহ অন্তত ১৩টি গ্রামের মানুষ স্লোগান দেন, “ত্রাণ চাই না, ভাত চাই না, টেকসই বেড়িবাঁধ চাই।” তাদের অভিযোগ, প্রতি বছর একই সময়ে বাঁধ ভেঙে তাদের বসতভিটা ও কৃষিজমি পানির নিচে ডুবে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সরকার থেকে কিছু ত্রাণ দেওয়া হলেও তা সাময়িক সমাধান। স্থায়ী সমাধানের অভাবে তারা বারবার একই দুর্যোগে পড়ছেন।
একজন ভুক্তভোগী আব্দুল মালেক বলেন, গত বছর একই জায়গায় বাঁধ ভেঙে ১৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল। তাদের পরিবারসহ কয়েকশ পরিবার দুই মাসেরও বেশি সময় পানির নিচে দুর্ভোগে কাটিয়েছিল। তার ভাষায়, “এবার যদি বাঁধ ভেঙে যায়, আমরা আর ঘরবাড়ি বাঁচাতে পারব না।”
ভাঙনে কৃষকের ক্ষতির আশঙ্কা
স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, এখনই যদি ভাঙন প্রতিরোধ না করা হয় তবে আসন্ন আমন মৌসুম ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। কৃষক আজিজুল হক বলেন, “আমরা আমনের চারা রোপণ করেছি। বাঁধ ভেঙে গেলে ফসল পানিতে তলিয়ে যাবে, আমরা পথে বসে যাব।”
এই আশঙ্কার কারণে কৃষকরা দিন-রাত অস্থির সময় পার করছেন। তাদের দাবি, দ্রুত টেকসই বাঁধ নির্মাণ না হলে কৃষির পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে।
নারীদের উদ্বেগ ও আতঙ্ক
শুধু কৃষক নন, গ্রামীণ গৃহিণীরাও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দা রহিমা খাতুন বলেন, “আমরা ত্রাণ চাই না, ভাত চাই না, শুধু একটা টেকসই বেড়িবাঁধ চাই। জোয়ারের চাপ বাড়লেই রাতে ঘুমাতে পারি না।”
তাদের অভিযোগ, পরিবারের নিরাপত্তা, শিশুদের পড়াশোনা—সবকিছুই বারবার ভাঙনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতি বছর একই পরিস্থিতি সহ্য করা সম্ভব নয় বলে তারা জানান।
জনপ্রতিনিধিদের দাবি
দেলুটি ইউনিয়নের স্থানীয় সদস্য পলাশ কুমার জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বারবার অনুরোধ করা হলেও সঠিক সময়ে টেকসই মেরামত করা হয় না। ফলে নিম্নমানের কাজের কারণে কিছুদিনের মধ্যে আবার বাঁধে ফাটল ধরে।
তার ভাষায়, “যদি এখনই জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করা না হয়, তাহলে যেকোনো মুহূর্তে এলাকা প্লাবিত হয়ে যাবে।” স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মনে করেন, প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও তার কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবেই প্রতি বছর একই সমস্যা থেকে যাচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সীমাবদ্ধতা
খুলনা বিভাগের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম স্বীকার করেন, অর্থের সীমাবদ্ধতার কারণে এখনই টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা যাচ্ছে না। তবে তিনি জানান, ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে জরুরি মেরামতের কাজ চলছে।
তিনি বলেন, “স্থায়ী সমাধানের জন্য ইতোমধ্যে একাধিক প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। অনুমোদন পেলেই দীর্ঘমেয়াদি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ সম্ভব হবে।”
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, এ ধরনের প্রতিশ্রুতি তারা প্রতি বছর শুনে আসছেন, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি।
অতীত অভিজ্ঞতা ও চলমান ভাঙন
স্থানীয়রা জানান, গত বছর ভাঙনের কারণে দেলুটি ইউনিয়নের প্রায় ১৩টি গ্রাম দীর্ঘ দুই মাস পানির নিচে ছিল। এতে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি কৃষিজমিরও ব্যাপক ক্ষতি হয়।
শুধু দেলুটি নয়, খুলনার পাইকগাছার হিতামপুর, দাকোপের বটবুনিয়া ও আচাবুনিয়া এলাকাতেও একই ধরনের ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফলে উপকূলজুড়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে ভাঙন আরও বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়। তারা মনে করেন, স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা রক্ষায় অবিলম্বে স্থায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত।
তাদের মতে, শুধু অস্থায়ী সংস্কার দিয়ে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করার পরিবর্তে একবার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি ও জনজীবন দুটোই সুরক্ষিত হবে।
সারসংক্ষেপ
খুলনা অঞ্চলের মানুষ বারবার একই দুর্ভোগে পড়ছেন। প্রতিবারই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও কার্যকর টেকসই সমাধান মিলছে না। স্থানীয়রা বলছেন, ত্রাণ বা সাময়িক সহায়তা নয়, এখন তাদের প্রয়োজন টেকসই বেড়িবাঁধ।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই দাবি কি দ্রুত বাস্তবে রূপ পাবে, নাকি উপকূলের মানুষদের আবারও একই দুর্ভোগ পোহাতে হবে?
এম আর এম – ০৯৪১, Signalbd.com