শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত সরকারি কর্মচারী বিধি লঙ্ঘনের শামিল এবং এর দায়ে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে বলে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার। তিনি বলেন, শিক্ষকদের এই ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি পেতে হবে এবং সরকার এ বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষকদের নবম গ্রেডের দাবিকে তিনি ‘অন্যায় ও অযৌক্তিক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সোমবার (১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসসকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এই কঠোর বার্তা দেন। তিনি অবিলম্বে শিক্ষকদের পরীক্ষা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং শিক্ষার্থীদের ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করাকে শিক্ষকতার নৈতিকতার পরিপন্থি বলে উল্লেখ করেছেন।
সরকারি বিধি লঙ্ঘন ও কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা সরকারি কর্মচারী বিধি লঙ্ঘনের দায়ে শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার শামিল।
তিনি বলেন, ‘মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ আন্দোলনের নামে যা করছেন, তা সরকারি আচরণবিধি লঙ্ঘনের শামিল।’ শিক্ষকদের সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘সরকারি আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য আপনাদের কিন্তু তৈরি থাকতে হবে। এখানে সরকার একেবারে দৃঢ়ভাবে তার অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে।’ এই কঠোর হুঁশিয়ারি ইঙ্গিত দেয় যে, সরকার শিক্ষকদের এই কর্মবিরতি ও পরীক্ষা বর্জনের আন্দোলনকে কোনোভাবেই বরদাস্ত করবে না এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত।
পরীক্ষা গ্রহণে আপোসহীন মনোভাব
শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে সরকারের আপোসহীন মনোভাবের কথা তুলে ধরেন শিক্ষা উপদেষ্টা। তিনি শিক্ষকদের অবিলম্বে পরীক্ষা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘পরীক্ষায় কোনো রকমের আপোস এখানে হবে না।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, শিক্ষকদেরকে অবশ্যই পরীক্ষা নিতে হবে, ‘যাতে শিক্ষার্থীদের উপরে যে চাপ এবং অভিভাবকদের উপরেও যে চাপ সেটা যেন লাঘব হয়।’ অনেক বিদ্যালয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও অনেক স্থানে তা বন্ধ রয়েছে—এ অবস্থাকে তিনি ‘একেবারেই অনভিপ্রেত’ বলে উল্লেখ করেন। পরীক্ষা বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
নবম গ্রেডের দাবি: অন্যায় ও অযৌক্তিক
অধ্যাপক ড. সি আর আবরার শিক্ষকদের মূল দাবি, অর্থাৎ নবম গ্রেডে বেতন স্কেল নির্ধারণের দাবিকে ‘অন্যায় ও অযৌক্তিক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি এই দাবির বিরুদ্ধে তিনটি প্রধান যুক্তি তুলে ধরেন:
১. চাকরির শর্ত লঙ্ঘন: তিনি বলেন, ‘চাকরি যখন নিয়েছিলেন তারা জানতেন তারা দশম গ্রেডে থাকবেন। সেখান থেকে নবম গ্রেডের এই দাবি, এটা তাদের চাকরির শর্তের মধ্যে মোটেই ছিল না। সুতরাং এইটা একটা অন্যায্য ও অন্যায় দাবি।’ ২. বিসিএস ক্যাডারের সমতা: তিনি উল্লেখ করেন, নবম গ্রেডে মূলত বিসিএস এডমিন ক্যাডারের কর্মকর্তারা আসেন। কাজেই শিক্ষকদের এই দাবি এককভাবে কোনো মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘এটা হচ্ছে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বিষয়। এই পদে যে কেউ হুট করে চাইলেই যেতে পারে না।’ ৩. তুলনামূলক বিবেচ্য বিষয়: উপদেষ্টা বলেন, নবম গ্রেডে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি কম্পারেটিভ বিষয় রয়েছে, যা সামগ্রিক সরকারি কাঠামো বিবেচনা করে নির্ধারণ করতে হয়।
এই যুক্তিগুলোর মাধ্যমে সরকার শিক্ষকদের বেতন গ্রেডের দাবি মেনে না নেওয়ার স্পষ্ট অবস্থান জানিয়ে দিল।
শিক্ষার্থীদের ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার অনৈতিক
শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষকদের আন্দোলনের সময় ও কৌশল নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, দিন দুয়েক আগে তারা এই দাবি উত্থাপন করেছে। এমন সময় যখন তাদের স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা চলছে। অথবা কোনো কোনো জায়গায় বার্ষিক পরীক্ষা বা টেস্ট পরীক্ষা যখন হবে।’
তিনি অভিযোগ করেন, শিক্ষকরা মূলত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ব্যবস্থাকে ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করছেন। তিনি বলেন, ‘যেটা শিক্ষক হিসেবে চরম একটি অনৈতিক কাজ তারা করছেন।’ একজন শিক্ষকের নৈতিকতার পরিপন্থি এই ধরনের কাজকে সরকার কঠোরভাবে দেখছে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে জানা গেছে, ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকরা পরীক্ষায় আগ্রহী, শুধু একটি অংশের শিক্ষকই পরীক্ষা নিচ্ছেন না।
শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রস্তুতি ও সরকারি সিদ্ধান্ত
অধ্যাপক ড. সি আর আবরার শিক্ষকদের সতর্ক করে বলেন, ‘কাজেই আমরা তাদের অযৌক্তিক দাবি প্রত্যাখ্যান করছি এবং আমরা তাদেরকে বলছি যে, আপনারা আগামীকাল থেকে পরীক্ষা নেন। অন্যথায় সরকারি কর্মচারী হিসেবে বিধি লঙ্ঘনের দায়ে যে শাস্তি রয়েছে সেগুলোর জন্য আপনাদের কিন্তু তৈরি থাকতে হবে।’
এই হুঁশিয়ারি সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, আগামীকাল থেকে যদি পরীক্ষা শুরু না হয়, তবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই শাস্তির মধ্যে বেতন কর্তন, পদাবনতি বা অন্যান্য কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। সরকারের এই কঠোর অবস্থান শিক্ষক আন্দোলনে একটি বড় চাপ সৃষ্টি করবে।
শিক্ষকতার নৈতিকতা ও শিক্ষার ভবিষ্যৎ
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরারের এই কঠোর বক্তব্য শিক্ষক আন্দোলন এবং সরকারের অবস্থানকে চূড়ান্তভাবে স্পষ্ট করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে নবম গ্রেডের দাবিকে অযৌক্তিক বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী বিধি লঙ্ঘনের দায়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ব্যবস্থাকে ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করাকে তিনি শিক্ষকতার নৈতিকতার পরিপন্থি বলে অভিহিত করেছেন। এখন দেখার বিষয়, সরকারের এই কঠোর অবস্থানের পরও শিক্ষকরা তাদের কর্মবিরতি চালিয়ে যান কিনা, নাকি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরীক্ষা গ্রহণে ফিরে আসেন। তবে এই সংঘাতের চূড়ান্ত ক্ষতি দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ওপরই পড়বে।
এম আর এম – ২৪৬৯, Signalbd.com



