রাকসু ফান্ডের ১২ লাখ টাকা ফেরতের দাবি: মুজিব শতবর্ষ ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রাবিতে
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) আবারও আলোচনায়। নবনির্বাচিত রাকসু প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, মুজিব শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে রাকসু ফান্ড থেকে প্রায় ১২ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছিল, যার সুনির্দিষ্ট হিসাব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে নেই। শুধু তাই নয়, এর আগেও তিন মেয়াদে রাকসু তহবিল থেকে অর্থ তোলা হলেও সেই ব্যয়ের কোনো রেকর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পাওয়া যায়নি।
বুধবার (৫ নভেম্বর) দুপুরে রাকসু ভবনের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন নবনির্বাচিত নেতৃবৃন্দ। তারা অভিযোগ করেন, দীর্ঘ ৩৬ বছর অচলাবস্থার পর রাকসু পুনরুজ্জীবিত হলেও পুরনো আর্থিক অনিয়মের বোঝা এখনো টেনে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে সংগঠনটিকে।
প্রথম সভাতেই পুরনো হিসাব নিয়ে ক্ষোভ
নবনির্বাচিত নেতারা জানান, শপথগ্রহণের একদিন পরই রাকসুর প্রথম কার্যনির্বাহী সভা অনুষ্ঠিত হয়। তারা আশা করেছিলেন, ওই সভায় রাকসুর পূর্ববর্তী ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ অডিট রিপোর্ট পাওয়া যাবে এবং তহবিলের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা তৈরি হবে। কিন্তু সেই আশায় গুঁড়েবালি।
সভায় উপস্থিত নেতারা জানান, বর্তমান সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষ তাদের কাছে কোনো স্পষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। ফলে তহবিলের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন আরও জোরালো হয়।
একজন প্রতিনিধি বলেন,
“রাকসু ৩৬ বছর নিষ্ক্রিয় থাকলেও প্রশাসন নিয়মিতভাবে কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু সেই সময়ে কারা কীভাবে তহবিল ব্যবহার করেছে, তার কোনো রেকর্ড রাখা হয়নি। এটি ছাত্রসমাজের প্রতি অন্যায়।”
২০১৩ সালের আগে হিসাব ‘অদৃশ্য’
রাকসুর অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল সেক্রেটারি (এজিএস) সালমান সাব্বির সংবাদ সম্মেলনে বলেন,
“বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ২০১৩ সালের আগের কোনো ব্যাংক হিসাব বা ব্যয়ের রিপোর্ট দিতে পারছে না। সেই সময়ে যেসব সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষ দায়িত্বে ছিলেন, তারা কোন খাতে কত টাকা ব্যয় করেছেন, তার কোনো লিখিত তথ্য নেই।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“আমরা ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জবাব চাইবো। কারণ রাকসু ফান্ড ছাত্রদের অর্থ—এটি ছাত্রকল্যাণ ছাড়া অন্য কোথাও ব্যয় করা বেআইনি। কেউ যদি অপব্যবহার করে থাকেন, তাহলে ব্যক্তিগতভাবেও সেই টাকা ফেরত দিতে হবে।”
মুজিব শতবর্ষ ব্যয়ে প্রশ্ন
রাকসুর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) সালাহউদ্দীন আম্মার বলেন,
“প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মুজিব শতবর্ষ উদযাপনে প্রায় ১২ লাখ টাকা রাকসু ফান্ড থেকে খরচ করা হয়েছে। কিন্তু এই ব্যয় কোথায়, কীভাবে এবং কার অনুমোদনে হয়েছে—তার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।”
তিনি আরও জানান, ২০১৩ সালের পর থেকে ব্যাংক হিসাব পাওয়া গেলেও, ১৯৯০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ২২ বছরের আর্থিক লেনদেনের তথ্য হারিয়ে গেছে। ফলে প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
রাকসুর কোষাধ্যক্ষের বক্তব্য
এ বিষয়ে রাকসুর বর্তমান কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সেতাউর রহমান বলেন,
“আমার জানা মতে, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে রাকসু ফান্ড থেকে কিছু অর্থ বিভিন্ন হলে শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যয় করা হয়েছিল। তবে সেটি আইনসিদ্ধ ছিল কি না, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।”
তিনি আরও বলেন,
“যদি দেখা যায় সেই সময়ের ব্যয় আইনসিদ্ধ নয়, তাহলে প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তা পুনরুদ্ধার করতে পারেন। তবে এখনো এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।”
তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি
নবনির্বাচিত নেতারা জানান, তারা ইতিমধ্যে রাকসু ফান্ডের অডিট ও তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠনের দাবি তুলেছেন। সেই কমিটি গঠন হলে বিগত সময়ের সব অনিয়মের তদন্ত সম্ভব হবে।
একজন নির্বাচিত সিনেট সদস্য বলেন,
“রাকসু শুধু ছাত্র রাজনীতির প্রতীক নয়, এটি শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার প্রতিষ্ঠান। তাই তহবিলের প্রতিটি টাকার হিসাব জনগণের জানার অধিকার।”
নেতারা আরও জানান, রাকসুর ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো স্বচ্ছ আর্থিক ব্যবস্থাপনা গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাকসুর পুনর্জাগরণ
উল্লেখ্য, ১৯৮৯-৯০ শিক্ষাবর্ষে রাকসুর ১৪তম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নানা জটিলতায় দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে এই সংগঠন নিষ্ক্রিয় ছিল।
অবশেষে ২০২৫ সালের ১৬ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় ১৫তম রাকসু নির্বাচন, যেখানে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেন।
এই নির্বাচনের মাধ্যমে রাকসু কার্যক্রম আবারও শুরু হলেও, পুরনো আর্থিক অনিয়মের ছায়া নতুন প্রশাসনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাকসুর অতীত ও বিতর্ক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে রাকসু ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রসংসদ, যা একসময় শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের মূল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু ১৯৯০-এর পর থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কারণে এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
রাকসু ভবনটি বহু বছর অব্যবহৃত থাকায় এর অনেক নথি ও রেকর্ড হারিয়ে যায়। সেই ফাঁকেই ফান্ড সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগও বাড়তে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক শিক্ষক বলেন,
“রাকসু পুনরুজ্জীবনের আগে প্রশাসনের উচিত ছিল পুরনো হিসাব-নিকাশের পূর্ণাঙ্গ অডিট সম্পন্ন করা। এখন তা না করায় নতুন নেতৃত্বকে অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে পড়তে হচ্ছে।”
ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ইতিহাস বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন,
“ছাত্রদের কল্যাণের জন্য যে টাকা, তা যদি অন্যখাতে খরচ হয়—তাহলে সেটা অন্যায়। নতুন রাকসু প্রশাসন যদি সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে চায়, তাহলে প্রথম কাজ হওয়া উচিত পুরনো সব অনিয়মের বিচার।”
আরেকজন শিক্ষার্থী যোগ করেন,
“মুজিব শতবর্ষ একটি রাষ্ট্রীয় আয়োজন, কিন্তু সেই খরচ যদি রাকসুর ছাত্রফান্ড থেকে করা হয়, তাহলে সেটা অনৈতিক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত এ বিষয়ে স্বচ্ছ ব্যাখ্যা দেওয়া।”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
বিশ্লেষকদের মতে, রাকসু ফান্ড ব্যবস্থাপনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরদারি আরও শক্তিশালী করা জরুরি। কারণ, রাকসু ফান্ডে প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ জমা হয়।
একজন সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান,
“রাকসু তহবিল ছাত্রকল্যাণমূলক কার্যক্রমে ব্যয় করার নিয়ম থাকলেও, অনেক সময় প্রশাসনের বিভিন্ন প্রকল্পে এই ফান্ড থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে—যা নিয়মবহির্ভূত।”
তিনি আরও বলেন,
“যদি কোনো সময় রাকসু অকার্যকর থাকে, তবুও ফান্ড জমা হতে থাকে। তাই এত বছরের টাকার সঠিক হিসাব এখন বের করা খুব কঠিন হয়ে গেছে।”
ভবিষ্যতের পথচলা: স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি
রাকসুর নবনির্বাচিত নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তারা ফান্ড ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল ট্রান্সপারেন্সি সিস্টেম চালু করবেন, যাতে প্রতিটি আয়-ব্যয়ের তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করা হয়।
জিএস সালাহউদ্দীন আম্মার বলেন,
“রাকসু হবে শিক্ষার্থীদের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি প্রতিষ্ঠান। আমরা চাই না আগের মতো অস্বচ্ছতা চলুক। ডিজিটাল অডিট ও অনলাইন রিপোর্টিং সিস্টেম চালুর মাধ্যমে সবকিছু উন্মুক্ত করা হবে।”
রাকসু ফান্ডের ১২ লাখ টাকার ফেরত দাবি কেবল অর্থের প্রশ্ন নয়; এটি স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও নৈতিকতার প্রতীকী দাবি। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাকসুর পুনর্জাগরণ শিক্ষার্থীদের আশা জাগালেও, পুরনো অনিয়মের ধোঁয়া এখনো ঘনীভূত।
ছাত্রসমাজ এখন তাকিয়ে আছে—রাকসু কি সত্যিই নতুন এক স্বচ্ছ যুগে প্রবেশ করতে পারবে, নাকি আগের মতোই অনিশ্চয়তার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে?
রাকসুর ১২ লাখ টাকার হিসাবের এই বিতর্ক শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, এটি বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হয়ে উঠতে পারে।
MAH – 13637 I Signalbd.com



