আন্তর্জাতিক বিরোধিতা সত্ত্বেও ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ চালিয়ে যাবে: ইরানের প্রেসিডেন্ট
আন্তর্জাতিক চাপ ও পশ্চিমা দেশগুলোর বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। তিনি বললেন, এটি ইরানের সার্বভৌম অধিকার এবং এই কার্যক্রম আন্তর্জাতিক আইনের সীমার মধ্যেই পরিচালিত হবে।
ইরানের প্রেসিডেন্টের স্পষ্ট ঘোষণা
সম্প্রতি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় প্রচারিত এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মহলের বিরোধিতা সত্ত্বেও ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ অব্যাহত রাখবে। তার ভাষায়, “আমাদের পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামোর মধ্যেই পরিচালিত হচ্ছে, এবং এটি ইরানের সার্বভৌম অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।”
তিনি আরও বলেন, “যদিও আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে, তবে ইরান কোনো অবস্থাতেই নিজের স্বার্থ ও অধিকার বিসর্জন দেবে না। আমরা আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথচলা থেকে সরে আসব না।”
পরমাণু কর্মসূচির পেছনের ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (JCPOA), যা সাধারণত ‘ইরান নিউক্লিয়ার ডিল’ নামে পরিচিত, এর মাধ্যমে ইরান কিছু শর্তের বিনিময়ে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত করেছিল।
তবে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে এই চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পর পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পর ইরান ধীরে ধীরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়াতে শুরু করে।
সাম্প্রতিক উত্তেজনা ও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক
পেজেশকিয়ান তার বক্তব্যে ইসরায়েলকেও ইঙ্গিত করে বলেন, ইসরায়েলের যেকোনো সামরিক আগ্রাসনের জন্য ইরান সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তিনি জানান, “আমরা শুধু কথায় নয়, কার্যক্রমেও প্রস্তুত। ইসরায়েলের যেকোনো হামলার পাল্টা জবাব দিতে ইরানের সশস্ত্র বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে।”
উল্লেখ্য, গত মাসে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে ১২ দিনের সামরিক সংঘর্ষ হয়, যেখানে দুই পক্ষের বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। এই সংঘর্ষের পটভূমিতে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু করা হয় বলে জানা গেছে।
প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানের অবস্থান ও কূটনৈতিক বার্তা
যদিও তিনি কঠোর অবস্থান নিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান একই সঙ্গে ভবিষ্যৎ আলোচনার জন্য দরজা খোলা রেখেছেন। তার ভাষায়, “আমরা কূটনীতিতে বিশ্বাস করি। তবে আলোচনাগুলো হতে হবে পারস্পরিক সম্মান ও বিজয়ী-বিজয়ী ভিত্তিতে। হুমকি কিংবা চাপে কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়।”
তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি সম্পর্কে বলেন, “যারা বলেন, ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস হয়ে গেছে, তারা বিভ্রমে আছেন। আমাদের সক্ষমতা কোনো ভবনে নয়, এটি আমাদের বিজ্ঞানীদের মস্তিষ্কে।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক সম্ভাবনা
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানের এমন অবস্থান ইঙ্গিত দেয় যে দেশটি আবারও পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনায় বসতে আগ্রহী। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর শর্ত মেনে নেবে না বলেও ইঙ্গিত মিলছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইরানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে, যা দেশটির অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। এই পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক সমাধান ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনা কমার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
মাসুদ পেজেশকিয়ান সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং তার নেতৃত্বে ইরান কিছুটা মধ্যপন্থী কূটনৈতিক ভাষা ব্যবহার করছে। তবে জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সরকার কোনো ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়।
তিনি জনগণের সামনে একটি শক্তিশালী ও আত্মনির্ভরশীল ইরানের ছবি তুলে ধরছেন, যেখানে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ বা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব স্বীকার না করেই প্রযুক্তি ও সামরিক খাতে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্প দৃঢ়।
ভবিষ্যৎ কী?
এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আসন্ন কূটনৈতিক তৎপরতা এবং পশ্চিমাদের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর।
বিশ্লেষকদের মতে, পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সংঘাত এড়াতে হলে দুই পক্ষকেই নমনীয় অবস্থান নিতে হবে। তবে ইরান বারবার যেভাবে নিজেকে প্রস্তুত ও আত্মবিশ্বাসী হিসেবে উপস্থাপন করছে, তা ভবিষ্যতে আরও সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করছে।
“আমাদের পারমাণবিক সক্ষমতা কোনো স্থাপনায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি রয়েছে আমাদের বিজ্ঞানীদের মন-মস্তিষ্কে”—ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান
সারসংক্ষেপ
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের দৃঢ় অবস্থান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ না করার ঘোষণার ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে।
প্রশ্ন উঠছে—এই উত্তেজনা কি আবারও নতুন করে যুদ্ধের ইঙ্গিত বহন করছে, নাকি কূটনৈতিক তৎপরতায় তৈরি হবে কোনো সমাধানের পথ?
এম আর এম – ০৪৮১ , Signalbd.com



