শিক্ষা

পাঠ্যবই ছাপার নতুন নিয়ম: প্রিন্টারের নাম ও মান নিয়ন্ত্রণ

Advertisement

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যবইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতি বছর কোটি কোটি শিক্ষার্থীকে নতুন বই বিতরণ করা হয়। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত থাকে বিশাল এক চ্যালেঞ্জ— বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ। গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে বইয়ের কাগজের মান খারাপ, ছাপা অস্পষ্ট এবং কিছু ক্ষেত্রে ভুলে ভরা বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছেছে। এসব সমস্যা দূর করতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ২০২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে বড় পরিবর্তন আনছে।

নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এবার থেকে প্রতিটি বইয়ের ফর্মায় বাধ্যতামূলকভাবে প্রিন্টারের নাম ছাপানো থাকবে। অর্থাৎ, কোন প্রতিষ্ঠান বইটি ছেপেছে তা সহজে চিহ্নিত করা যাবে। এর ফলে বই বিতরণের পর কোনো মানগত ত্রুটি ধরা পড়লে দায়ী প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।

কেন এই নতুন নিয়ম প্রয়োজন হলো?

এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরে কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান অনৈতিক পদ্ধতিতে বই ছেপে সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে। একটি বড় সমস্যা ছিল ‘ইনার চেঞ্জ’ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে কিছু প্রতিষ্ঠান নিজেদের বই না ছেপে অন্য কোথাও থেকে নিম্নমানের বই এনে শুধু নিজেদের নাম মুদ্রণ করত। এতে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাত নিম্নমানের বই, যা শিক্ষার গুণগত মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলত।

এই অনিয়ম বন্ধ করার জন্যই এনসিটিবি নতুন নিয়ম চালু করছে। এখন থেকে যে কোনো বইয়ের মানগত অভিযোগের ক্ষেত্রে দায়ী প্রতিষ্ঠানকে সহজেই শনাক্ত করা যাবে

কী কী পরিবর্তন আসছে বই ছাপায়?

২০২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে এনসিটিবি পাঠ্যবইয়ের মান উন্নয়নে বেশ কিছু বড় পদক্ষেপ নিচ্ছে। সেগুলো হলো—

প্রিন্টারের নাম বাধ্যতামূলক – প্রতিটি বইয়ের ফর্মায় ছাপানো থাকবে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের নাম।
উচ্চমানের কাগজ – আগে কাগজের ওজন ছিল ৮২ জিএসএম, এখন তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৮৫ জিএসএম।
কৃত্রিম ব্রাইটনার বাদ – চোখের জন্য ক্ষতিকর অপটিক্যাল ব্রাইটনার বাদ দিয়ে ১০০% প্রাকৃতিক পাল্প ব্যবহার করা হবে।
ব্রাইটনেস বাড়ানো হয়েছে – বইয়ের লেখা আরও স্পষ্ট ও চোখে আরামদায়ক হবে।
সিসিটিভি মনিটরিং – প্রতিটি প্রেসে বসানো হবে সিসিটিভি ক্যামেরা, যা ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং করবে।
দ্বৈত ল্যাব টেস্ট – কাগজের মান যাচাইয়ে দুটি আলাদা ল্যাবে পরীক্ষা করা হবে।
ইন্সপেকশন টিমের ওপর কঠোর নজরদারি – যাতে কেউ প্রভাবিত না হয়।

শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন নিয়মের সুবিধা কী?

এবারের পরিবর্তন শুধু বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণেই সীমাবদ্ধ নয়, শিক্ষার্থীদের চোখের স্বাস্থ্যের দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চক্ষু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে কাগজের মান নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে দীর্ঘ সময় পড়াশোনা করলেও চোখে চাপ না পড়ে।

নতুন কাগজ হবে আরও ঘন ও টেকসই
বইয়ের উজ্জ্বলতা এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে চোখে অস্বস্তি না হয়।
কৃত্রিম ব্রাইটনার বাদ দেওয়ায় চোখের ক্ষতির ঝুঁকি কমেছে।

প্রকাশকদের জন্য চ্যালেঞ্জ

নতুন নিয়মের ফলে বই ছাপার খরচ কিছুটা বেড়েছে। কারণ—
✔ ভার্জিন পাল্পের কাগজ ব্যবহার
✔ কাগজের ওজন ও ব্রাইটনেস বাড়ানো
✔ সিসিটিভি ক্যামেরা ও মনিটরিং সিস্টেম

ফলে কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান অভিযোগ করছে যে প্রতিযোগিতা কমে গিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যা সরকারের জন্য বাড়তি খরচের কারণ হতে পারে।

বাড়তি খরচ কতটা?

প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে বই ছাপার খরচ বাড়ছে প্রায় ৩২৩ কোটি টাকা। এর কারণ—
✔ প্রাথমিক পর্যায়ে ১৩০ কোটি ফর্মায় প্রতিটি ৩৯ পয়সা বেশি
✔ মাধ্যমিকে ৪৪৫ কোটি ফর্মায় ৫০ পয়সা বেশি

তবে এনসিটিবি বলছে, মান উন্নয়নের জন্য এই ব্যয় যৌক্তিক

বিশেষজ্ঞদের মতামত

এনসিটিবি সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন—
“শিক্ষার্থীদের হাতে মানসম্পন্ন বই তুলে দিতে হলে আমাদের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বছর আমরা চোখের স্বাস্থ্য, কাগজের গুণগত মান এবং ছাপার মান— সব দিকেই নজর দিয়েছি। এ জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”

ভবিষ্যতের পরিকল্পনা

✔ এনসিটিবি অনলাইনে বই ছাপার মনিটরিং চালু করবে।
✔ প্রতিটি বইয়ে QR কোড যোগ হতে পারে, যাতে ছাপার তথ্য থাকবে।
✔ মুদ্রণ ত্রুটি কমাতে অটোমেশন সিস্টেম চালু হবে।

বাংলাদেশে পাঠ্যবই বিতরণ একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রতি বছর কোটি কোটি বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এর মান বজায় রাখতে এনসিটিবি’র নতুন পদক্ষেপ একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। যদিও খরচ কিছুটা বেড়েছে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল পাওয়া যাবে। শিক্ষার্থীরা পাবে উন্নত মানের বই, যা তাদের শেখার অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করবে।

MAH – 12499 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button