মানবাধিকার ও স্বাধীনতা এমন এক মৌলিক অধিকার, যা প্রতিটি মানুষ পেতেই জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু ইতিহাস ও সমাজের অনেক সময়ই দেখা গেছে, মানুষ তার এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে বা হরণ হয়েছে। বিশ্বসভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে নানা প্রকার অবিচার, বৈষম্য ও শোষণ বিদ্যমান ছিল। এ ক্ষেত্রে ইসলাম মানবাধিকার ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
মানবাধিকার ও স্বাধীনতার মহান আদর্শ ইসলামে
ইসলাম ধর্ম মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে দেখা যায়, আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে স্বাধীন সৃষ্টি করেছেন এবং কারো ওপর কারো কোনো শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেননি, তবে তাকওয়ার ভিত্তিতে ব্যতিক্রম আছে। মহান রাসুল মুহাম্মদ (সা.) এর বিদায় হজের ভাষণে তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছেন:
“হে লোকসকল! তোমাদের সকলের পালনকর্তা একজন এবং তোমাদের পিতাও একজন। আরবের ওপর অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কিংবা শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই; তাও শুধু তাকওয়ার কারণে। তোমরা সকলেই একে অপরের ভাই।”
— (মুসনাদে আহমদ: ২৩৪৮৯)
এ কথাটি মানবজাতির মধ্যে সমতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মানুষের জাতি, বর্ণ বা দেশভেদে কোনো বৈষম্য নয়, বরং প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করে তাকওয়া বা ভক্তি ও নৈতিকতা।
ইসলামে দাসত্ব ও শ্রেণী বৈষম্যের পরিণতি
ইসলাম কঠোরভাবে দাসত্ব ও অন্যায় শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে। আমিরুল মুমিনীন হজরত ওমর (রা.) তাঁর শাসনামলে একবার দাসত্বের অবৈধতার বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন:
“মানুষের স্বাধীনতা তাদের মায়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত। তাহলে কবে থেকে তোমরা তাদের দাস বানাতে শুরু করেছ?”
— (তারিখে তাবারি)
এ থেকে বোঝা যায়, ইসলামে মানুষের স্বাধীনতা একটি অপরিহার্য অধিকার, যা কেউ হরণ করতে পারে না। দাসত্ব বাতিল করা হয়েছে এবং সকল মানুষকে সমান মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে।
ইসলামে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও জবরদস্তির অস্বীকৃতি
ইসলাম শুধু শারীরিক স্বাধীনতাই নয়, ধর্মীয় স্বাধীনতাকেও অপরিহার্য মনে করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে বলেন:
“দ্বীনের (ধর্মের) ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। এখন হিদায়াত সুস্পষ্ট হয়ে গেছে গোমরাহি থেকে। যে কেউ তাগুতকে (অসৎ ও মিথ্যা উপাস্য) অস্বীকার করে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আনে, সে শক্ত ভিত্তিতে আঁকড়ে ধরে, যা কখনো ভাঙবে না।”
— (সূরা বাকারা: ২৫৬)
এ আয়াত ইসলামের ধর্মীয় সহনশীলতা ও স্বাধীনতার প্রকাশ। ইসলামে কাউকে জোর করে ধর্মান্তর করানো বা নির্দিষ্ট ধর্ম পালন বাধ্যতামূলক করা হয় না। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য মানুষের নিজস্ব চিন্তা ও বুদ্ধির মাধ্যমে বোঝা উচিত। চিন্তার স্বাধীনতাই প্রকৃত ধর্মীয় গ্রহণযোগ্যতার মূল চাবিকাঠি।
ইসলামের দৃষ্টিতে চিন্তার স্বাধীনতা
ইসলাম মানবতার চিন্তা স্বাধীনতাকেও অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। চিন্তা ও বুদ্ধি ব্যবহার না করে কেউ সত্যের সন্ধান পেতে পারে না। পবিত্র কোরআনে বারবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, মানুষ নিজের বুদ্ধি ও তর্ক-বিতর্ক দিয়ে ধর্ম ও জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে।
যে ব্যক্তি চিন্তার স্বাধীনতা হারায়, সে কখনোই প্রকৃত সত্যের সন্ধান পাবে না এবং সে অন্য কারও চিন্তার দাস হয়ে যাবে। ইসলাম তাই চিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে।
স্বাধীনতা ও স্বৈরাচারিতার মধ্যে পার্থক্য
আজকের সময়ে স্বাধীনতার নামে অনেকেই যে ধরনের অবাধ আচরণ করে, তা ইসলাম কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে। ইতিহাসে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও স্বৈরাচারী শাসকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফেরাউন। ফেরাউন নিজেকে খোদা দাবি করে, মানুষের উপর অত্যাচার চালাতো, বিশেষত দুর্বল ও অবহেলিত শ্রেণীকে নিপীড়িত করতো।
পবিত্র কোরআনে ফেরাউনের অত্যাচারের বর্ণনা এসেছে:
“ফেরাউন ভূমিতে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল এবং মানুষদের শ্রেণীভেদ করেছিল; দুর্বলদের কষ্ট দিতো, তাদের সন্তানদের হত্যা করত, কন্যাসন্তানদের বাঁচিয়ে রাখত। সে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ছিল। আল্লাহ যাদের দুর্বল করে রেখেছিল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করলেন এবং তাদেরকে পৃথিবীর শাসক বানালেন।”
— (সূরা কাসাস: ৪-৬)
এখানে ইসলামের শিক্ষা হল—স্বাধীনতা মানে অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করে নিজেকে খোদার সমান বা অধিক শক্তিশালী মনে করা নয়, বরং এটি মানুষের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বের সঙ্গে সমন্বিত হওয়া উচিত।
ইসলামের দৃষ্টিতে আদর্শ মানবাধিকার চর্চা
আমাদের সমাজ, জাতি ও দেশের উন্নতির জন্য মানবাধিকার ও স্বাধীনতার সঠিক বাস্তবায়ন অপরিহার্য। ইসলাম যে স্বাধীনতার শিক্ষা দিয়েছে, সেটি মানবতা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
স্বাধীনতার নামে যদি অনিয়ন্ত্রিত আচরণ বা স্বেচ্ছাচারিতা প্রবণতা বাড়ে, তাহলে সেটি সমাজে অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা এবং অবিচারের জন্ম দেয়। এর ফলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়, শান্তি বিনষ্ট হয় এবং সমগ্র জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ধ্বংস হয়।
ইসলামিক মূল্যবোধ ও আধুনিক মানবাধিকার
বর্তমান বিশ্বের মানবাধিকার আন্দোলনের মূলমন্ত্রগুলো ইসলামে বহুলাংশে প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন, মানুষের সমতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, নারী ও শিশুর অধিকার রক্ষা, দাসপ্রথা নিরসন, সামাজিক ন্যায়বিচার—all এগুলো ইসলামে যুগ যুগ ধরে গৃহীত হয়েছে।
বিশ্বে আধুনিক মানবাধিকার ধারণাগুলো ইসলামের আদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে বলে অনেক ঐতিহাসিক ও গবেষক মত প্রকাশ করেছেন। ইসলামিক শিক্ষাগুলো মানবাধিকার নিশ্চিত করতে কতটা কার্যকর, তার প্রমাণ এখনো পৃথিবীর নানা দেশে দৃশ্যমান।
মানবাধিকার ও স্বাধীনতা ইসলামের মূল আদর্শ। ইসলাম শুধু শারীরিক স্বাধীনতাই দেয়নি, বরং চিন্তার, ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাধীনতার জন্যও অবস্থান নিয়েছে। ইসলামে সকল মানুষের প্রতি সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছে, যা মানুষকে দাসত্ব, বৈষম্য ও অত্যাচার থেকে রক্ষা করে।
আমরা যদি সত্যিকার অর্থে মানবাধিকার ও স্বাধীনতার সঠিক চর্চা করতে চাই, তবে ইসলামের শিক্ষা থেকে শিখতে হবে। কারণ ইসলামের মানবাধিকার ও স্বাধীনতার আদর্শই মানবজাতির কল্যাণে সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত।
MAH – 12066, Signalbd.com



