রবের সন্তুষ্টি অর্জনে হোক কোরবানি: ঈদুল আজহার তাৎপর্য ও মূল শিক্ষা

পবিত্র ঈদুল আজহা শুধু আনন্দ আর উৎসবের দিনই নয়—বরং এটি আত্মত্যাগ, আত্মনিয়োগ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক বিশাল প্রশিক্ষণের নাম। ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে কোরবানি, যা আমাদের শিখিয়ে দেয় ত্যাগের প্রকৃত মানে। এই নিবন্ধে কোরবানির ফজিলত, কোরআন-হাদিসের আলোকে এর গুরুত্ব এবং একজন প্রকৃত মুমিনের জীবনে কোরবানির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা হলো।
কোরবানির তাৎপর্য: ইসলামের দৃষ্টিতে ত্যাগ ও আনুগত্য
‘কোরবানি’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘কুরবান’ থেকে, যার অর্থ—আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে কিছু উৎসর্গ করা। ইসলামের দৃষ্টিতে কোরবানি হচ্ছে এমন একটি ইবাদত, যার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট পশু জবাই করা হয়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন—
“হে নবী, আহলে কিতাবদের তুমি আদমের দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের ঘটনা ভালো করে বর্ণনা করো। তারা যখন কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো। কিন্তু অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না। ক্ষিপ্ত হয়ে সে বলল, আমি তোমাকে খুন করব। অপরজন বলল, প্রভু তো শুধু আল্লাহ-সচেতনদের কোরবানিই কবুল করেন।”
—(সুরা মায়েদা: ২৭)
এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কোরবানি শুধু আকার বা রক্তপাত নয়, বরং তা হতে হবে তাকওয়ার ভিত্তিতে।
হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কোরবানির আদর্শ
ঈদুল আজহার পেছনে যে ইতিহাস রয়েছে তা আমাদের শেখায়—আল্লাহর আদেশ পালনের জন্য কিভাবে হজরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি দিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। এই আত্মত্যাগের ঘটনা কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
হাদিসে কোরবানির গুরুত্ব
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—
“কোরবানির দিন মানুষ যে কাজ করে তার মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় হচ্ছে রক্ত প্রবাহিত করা।”
—(তিরমিজি: ১৪৯৩)
এ ছাড়া সাহাবিদের জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বলেন—
“প্রত্যেক পশুর পশমের বিনিময়ে একটি করে সওয়াব লেখা হয়।”
—(ইবনে মাজাহ: ৩১২৭)
এই হাদিসগুলো থেকে বোঝা যায়—কোরবানির পশুর প্রতিটি অঙ্গ, এমনকি পশমও আল্লাহর দরবারে সওয়াবের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কোরবানির উদ্দেশ্য ও নিয়তের বিশুদ্ধতা
কোনো ইবাদতের মূল ভিত্তি হচ্ছে ‘নিয়ত’। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—
“সমস্ত কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভর করে। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পায়, যা সে নিয়ত করে।”
এই হাদিসের আলোকে বোঝা যায়, যদি কেউ লোক দেখানো কোরবানি দেয়, তাহলে তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। কোরবানির পশু যত দামি হোক না কেন, যদি নিয়ত বিশুদ্ধ না হয়, তা অর্থহীন।
আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার শর্ত: তাকওয়া ও খালিস নিয়ত
আল্লাহ বলেন—
“তোমাদের কোরবানির গোশত বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।”
—(সুরা হজ: ৩৭)
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, পশু জবাই নয়—বরং আমাদের মনের অবস্থাই আল্লাহর নিকট গুরুত্বপূর্ণ।
কোরবানি থেকে মুমিনের তিনটি শিক্ষা
১. আত্মনিয়ন্ত্রণ ও তাকওয়া:
কোরবানি আমাদের শেখায়, শুধু বাহ্যিকভাবে ধর্ম পালন যথেষ্ট নয়—আন্তরিকতা এবং আল্লাহভীতি থাকতে হবে। কেউ গরু বা ছাগল কোরবানি করলেও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের অভ্যন্তরীণ খারাপ চিন্তাও কোরবানি করতে হবে।
২. সমতা ও সহানুভূতি:
কোরবানির মাংস বিতরণে ধনী-গরিব সবাই এক হয়ে যায়। ঈদের আনন্দ যেন সমাজের সব স্তরে ছড়িয়ে পড়ে—এটাই ইসলামের শিক্ষা।
৩. আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য:
হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর মতো আমাদেরও আল্লাহর আদেশ মানতে কোনো দ্বিধা থাকা উচিত নয়। কোরবানি মানে শুধু পশু জবাই নয়, বরং নিজের অহংকার, লোভ, হিংসা ইত্যাদি নফসকেও কোরবানি দেওয়া।
কোরবানির সামাজিক তাৎপর্য
কোরবানি শুধু একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়—এটি সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতীক। এ সময় অসহায় মানুষের ঘরেও যেন ঈদের আনন্দ পৌঁছায়, সে ব্যবস্থা করতে হয়। ধনী ব্যক্তিদের উচিত—কোরবানির পর মাংসের সঠিক বণ্টন নিশ্চিত করা।
আল্লাহর সন্তুষ্টিই হোক কোরবানির একমাত্র লক্ষ্য
ইসলামের প্রতিটি ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। কোরবানির ক্ষেত্রেও বিষয়টি ভিন্ন নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কোরবানির পশু নির্বাচন, জবাই, বণ্টন—সব কিছুতেই সতর্কতা ও খালিস নিয়তের প্রয়োজন।
এই ঈদুল আজহায় আমাদের প্রত্যেকের উচিত হবে, কোরবানির মাধ্যমে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে শেখা, আত্মশুদ্ধির পথকে বেছে নেওয়া এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিকে জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্যে পরিণত করা।