বানিজ্য

নীতিমালা লঙ্ঘন করে লাইসেন্স: সামিট গ্রুপের দখলে ইন্টারনেট খাত

দেশের আইসিটি ও টেলিকম খাতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে সামিট গ্রুপ। নীতিমালা লঙ্ঘন করে সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তায় প্রতিষ্ঠানটি ছয়টি লাইসেন্স পেয়েছে, যা বাজার প্রতিযোগিতার পরিপন্থী। বর্তমানে দেশের ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথের ৫০ শতাংশের বেশি সামিট গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অনুসন্ধানী সূত্রে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সামিটের একচ্ছত্র আধিপত্য ও বিতর্কিত লাইসেন্স

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সামিট গ্রুপ টেলিকম খাতে প্রবেশের সুযোগ পায়। ওই সময় সামিট চেয়ারম্যান আজিজ খানের ভাই ফারুক খান বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। সরকার গঠনের পরপরই সামিট গ্রুপ বিটিআরসি থেকে এনটিটিএন (ন্যাশনাল টেলিকম ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক) লাইসেন্স লাভ করে। পরে তারা আইটিসি (ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল), আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) ও আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) লাইসেন্সও অর্জন করে।

বিটিআরসির নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল (আইটিসি) লাইসেন্স তিনটির বেশি দেওয়া হবে না। কিন্তু ২০১২ সালে সরকার ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদান করে, যার মধ্যে সামিট গ্রুপ অন্যতম।

বাজার প্রতিযোগিতায় বৈষম্য ও ভারতনির্ভরতা

বিশ্লেষকদের মতে, সামিট গ্রুপের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের ফলে বাংলাদেশের ইন্টারনেট খাত ভারতনির্ভর হয়ে পড়েছে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। বিটিআরসি-র নীতিমালায় বলা ছিল, কোনো অপারেটর দেশের ৬০ শতাংশের বেশি ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ করতে পারবে না। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের বিশেষ সুবিধা পেয়ে সামিট এই সীমা লঙ্ঘন করেছে।

সরকারি ব্যান্ডউইডথ অব্যবহৃত রেখে ভারত থেকে ব্যান্ডউইডথ আমদানি করা হচ্ছে, যা দেশের ডিজিটাল অবকাঠামোকে বিদেশনির্ভর করে তুলছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি দেশের সাইবার নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

সামিটের সাবমেরিন ক্যাবল নিয়ন্ত্রণ

বিটিআরসি সামিট গ্রুপকে সাবমেরিন ক্যাবলের লাইসেন্স প্রদান করেছে, যা তাদের আধিপত্য আরও দৃঢ় করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সামিটের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি উঠেছে। তবে সরকার এখনো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

বিশেষজ্ঞদের মতামত: তারা বলছেন, সামিট গ্রুপের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ ব্যাহত হয়েছে এবং গ্রাহকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

ইন্টারনেট খাতে ৫০ শতাংশের বেশি সামিটের নিয়ন্ত্রণে

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের ইন্টারনেট অবকাঠামো এত বেশি ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠা একটি কৌশলগত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এটি বাংলাদেশের ডিজিটাল স্বাধীনতাকে গুরুতরভাবে হুমকির মুখে ফেলতে পারে, বিশেষ করে যদি দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক টানাপড়েন বা উত্তেজনা তৈরি হয়। যদি কোনো কৌশলগত কারণে ভারত আইটিসি সংযোগ সীমিত বা বন্ধ করে দেয়, তবে বাংলাদেশের ইন্টারনেট কার্যক্রম বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপরও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে, যা দেশের ডিজিটাল অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জে ফেলবে।

মন্ত্রণালয়ের নথি থেকে জানা গেছে, সরকারের নিজস্ব সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে বাংলাদেশের ইন্টারনেটের প্রায় ৭০ শতাংশ সরবরাহ করা হচ্ছে ভারত থেকে, যার ৫০ শতাংশের বেশি সামিট গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। ফলে দেশের ইন্টারনেট অবকাঠামো একক নির্ভরতার ঝুঁকিতে পড়েছে, যা সরাসরি ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, এই ক্রমবর্ধমান ভারতনির্ভরতা বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। দেশের প্রধান ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ প্রবাহ সামিটের মাধ্যমে ভারত হয়ে বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় বাংলাদেশি তথ্যের ওপর ভারতের একক নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতে স্পর্শকাতর জাতীয় তথ্য ফাঁস হওয়ার ঝুঁকি যেমন বেড়েছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বও হুমকির মুখে পড়েছে। এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে- সামিট গ্রুপের এই একচ্ছত্র আধিপত্য কাদের স্বার্থে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কেন এখনো এই গুরুতর নিরাপত্তা ইস্যুতে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না!

বাড়ছে রিজার্ভের ওপর চাপ

শুধু মূল্য কম অথবা ল্যাটেন্সির (কোনো সিস্টেমে তথ্য আদান-প্রদানের বিলম্ব বা দেরি) অজুহাত দেখিয়ে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান যেমন এয়ারটেল, রিলায়েন্স জিও, টাটা কমিউনিকেশনের সঙ্গে যোগসাজশে ভারত থেকে আমদানি চালু রাখতে এবং তার জন্য পলিসি নির্ধারণে আগ্রহী সামিটসহ অন্যান্য আইটিসি প্রতিষ্ঠান। এতে আসলে লাভ হচ্ছে ভারত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর। স্বল্প বিনিয়োগে তারা শত শত কোটি টাকা লাভ করছে, কিন্তু এর ফলে বাংলাদেশকে বছরে ৪০ মিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে রিজার্ভ থেকে।

সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএসসিপিএলসির মোট সক্ষমতা ৭২০০ জিবিপিএস হলেও বর্তমানে মাত্র ৩০০০ জিবিপিএস ব্যবহার হচ্ছে; অর্থাৎ প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যান্ডউইডথ অব্যবহৃত রয়েছে। তাছাড়া ২০২৬ সালের মধ্যে সিমিউ-৬ চালু হলে এর সক্ষমতা বেড়ে ২০ হাজার জিবিপিএসে পৌঁছাবে। প্রয়োজনে নীতিমালা সংশোধন করে এই সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের বড় বড় টেক জায়ান্ট যেমন ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজনকে নীতিগত সুবিধা দেওয়া উচিত, যাতে তারা বাংলাদেশে ডেটা সেন্টার স্থাপন করতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের ইন্টারনেটের একটি বড় অংশই ফেসবুক এবং গুগলের সার্ভার থেকে আসে, যেগুলো ভারতের চেন্নাই, কলকাতা শহরগুলোতে স্থাপিত রয়েছে। এর ফলে ভারত সরকার লাভবান হচ্ছে এবং বাংলাদেশ সরকার একদিকে রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে নতুন কর্মসংস্থান তৈরির সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button