কর্মকর্তাদের পোশাক নির্দেশনায় সংযম ও সম্মান বজায় রেখে নীতিমালা সংশোধন
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অফিস পোশাক পরিধানের বিষয়ে যে নির্দেশনা জারি হয়েছিল, তা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরে আজ বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই নির্দেশনা প্রত্যাহারের মাধ্যমে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতাকে সম্মান জানিয়েছে এবং কর্মীদের স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে।
পোশাক নির্দেশনা: কি ছিল বিষয়?
গত ২১ জুলাই, বাংলাদেশ ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ কর্তৃক একটি নির্দেশনা প্রকাশিত হয়, যেখানে সব স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অফিসিয়াল সময়ে নির্দিষ্ট পোশাক পরিধানের নিয়মাবলী দেয়া হয়েছিল। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছিল:
- নারী কর্মীদের জন্য: শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ ও ওড়না বা অন্য কোনো পেশাদার ও মার্জিত পোশাক পরিধান বাধ্যতামূলক।
- শর্ট স্লিভ বা ছোট দৈর্ঘ্যের পোশাক, লেগিংস পরিহার করার কথা বলা হয়।
- ফরমাল স্যান্ডেল বা জুতা এবং সাদামাটা হেডস্কার্ফ বা হিজাব পরার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
- পুরুষদের জন্য: লম্বা বা হাফ হাতার আনুষ্ঠানিক শার্ট ও ফরমাল প্যান্ট পরিধান বাধ্যতামূলক, জিন্স ও গ্যাবার্ডিন প্যান্ট পরিহার করতে বলা হয়েছিল।
এছাড়াও নির্দেশনায় উল্লেখ ছিল, যারা এই নিয়ম মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনা হতে পারে।
সমালোচনা ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
নির্দেশনাটি প্রকাশের পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে ফেসবুক, টুইটার এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেন যে, এই পোশাক নীতি নারী ও পুরুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হরণ করতে পারে। অনেকেই এই নির্দেশনাকে ‘অপ্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ’ এবং ‘পুরনো মানসিকতার নিদর্শন’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
বিশেষত নারীদের পোশাক নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি বেশ বিতর্কিত হয়। কয়েকজন কর্মী এবং নাগরিক বলেন, “একজন কর্মীর পোশাক নির্বাচনে এমন বিধিনিষেধ দেওয়া উচিত নয়, বিশেষ করে যখন দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ ইতোমধ্যেই বৈচিত্র্যময়।”
অনেকে মন্তব্য করেন, এই ধরনের নির্দেশনা কর্মীদের সৃজনশীলতা এবং ব্যক্তিত্ব প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ: নির্দেশনা প্রত্যাহার
সমালোচনার মাত্রা বাড়ার পর, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, যিনি বর্তমানে বিদেশে অবস্থানরত, বিষয়টি জানতে পেরে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। গভর্নরের নির্দেশ মোতাবেক দ্রুতই পোশাক সংক্রান্ত নির্দেশনাটি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাঠানো এক অফিসিয়াল বিবৃতিতে বলা হয়,
“বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে অফিস সময়ে পেশাদার ও মার্জিত পোশাক পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তবে এটি কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নয় এবং কোনো সার্কুলার জারি করা হয়নি। যেহেতু বিষয়টি গভর্নরের নজরে এলে তিনি তা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন, সুতরাং নির্দেশনাটি এ মুহূর্তে বাতিল করা হলো।”
পোশাক নিয়ন্ত্রণ বনাম ব্যক্তিগত স্বাধীনতা
বাংলাদেশ ব্যাংকের পোশাক নীতির বিতর্কটি মূলত আধুনিক অফিস সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী সামাজিক মূল্যবোধের মধ্যে টানাপোড়েনের একটি দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশের অফিস বা সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেক সময় পোশাক নির্ধারণ করা হয় পেশাদারিত্ব এবং ঐক্যের উদ্দেশ্যে, তবে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং সামাজিক বহুমাত্রিকতার সঙ্গে তার সামঞ্জস্য রক্ষা করাও জরুরি।
পেশাদার পোশাক পরিধান কর্মক্ষেত্রে সম্মান ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয়, কিন্তু সেটি যেন কর্মীদের ব্যক্তিগত পছন্দ ও সংস্কৃতিকে ক্ষুণ্ন না করে, সে দিকেও মনোযোগ দিতে হবে।
বিশ্বব্যাপী আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্বাধীনতা বজায় রেখে পোশাক নীতি নির্ধারণ করে থাকে।
বাংলাদেশের অফিস সংস্কৃতিতে পোশাকের ভূমিকা
বাংলাদেশের অফিস সংস্কৃতি ঐতিহ্যগত ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ। অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এখনও শাড়ি ও সালোয়ার-কামিজ এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী কর্মপোষাক হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে আধুনিক তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্যান্ট, শার্ট ও অন্যান্য পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক জনপ্রিয়।
অতীতে, পোশাক সংক্রান্ত বিভিন্ন নির্দেশনা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রকাশিত হলেও তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা রক্ষা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ঘটনাটি দেশের অফিস সংস্কৃতিতে পোশাকের পরিবর্তনশীলতার এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
ভবিষ্যৎ: কর্মক্ষেত্রে পোশাক নীতি এবং পরিবর্তনের সুযোগ
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও কর্মক্ষেত্রে পোশাক নীতিমালা নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
কর্মীদের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের পেশাদারিত্ব বজায় রাখার ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হলে সেটি সবচেয়ে সুষ্ঠু সমাধান হবে।
এছাড়া, অফিসে পোশাকের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য কমিয়ে আনতে এবং সকলের সম্মান বজায় রাখতে সচেতনতা বৃদ্ধি করাও জরুরি।
সারসংক্ষেপ
- ২১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পোশাক নির্দেশনা দেয়।
- নির্দেশনায় নারীদের শর্ট স্লিভ, ছোট দৈর্ঘ্যের পোশাক এবং লেগিংস পরিহার করতে বলা হয়।
- পুরুষদের জন্য আনুষ্ঠানিক শার্ট ও প্যান্ট পরিধান বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হয়।
- নির্দেশনার ব্যাপক সমালোচনার কারণে গভর্নর নির্দেশ দেন তা প্রত্যাহার করতে।
- আজ ২৪ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক এই নির্দেশনা প্রত্যাহার করে।
- অফিস পোশাক নীতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও সামাজিক সংবেদনশীলতা বিবেচনা করা জরুরি।



