রাজশাহীতে আমের বাম্পার ফলন, কমেছে দাম

রাজশাহীসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে এবার আমের মৌসুম শুরু হয়েছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অন্তত ৮–১০ দিন আগে। বাজার ইতিমধ্যে ভরে উঠেছে গুটি, গোপালভোগ, লক্ষ্মণভোগ, হিমসাগর ও ল্যাংড়া আমে। তবে এর চেয়েও বড় খবর হলো—গত বছরের তুলনায় এবারে আমের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কম। বাজারে প্রতিমণ আম ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত কম দামে বিক্রি হচ্ছে।
ফলন ভালো, আবহাওয়া অনুকূলে
চাষি ও কৃষি কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, চলতি বছর রাজশাহী অঞ্চলে আমের উৎপাদন আশাব্যঞ্জক। গাছে মুকুল এসেছে প্রায় ৯৮ শতাংশ গাছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ঝড়, শিলাবৃষ্টি বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় অধিকাংশ মুকুল টিকে গেছে এবং ফলে পরিণত হয়েছে।
রাজশাহী অঞ্চলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মোছা. সাবিনা বেগম বলেন, “এ বছর আমাদের অঞ্চলজুড়ে আমের গাছে প্রচুর মুকুল এসেছিল। যেহেতু আবহাওয়া সহায় ছিল, তাই ফলনও বেড়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আমরা রাজশাহীতে ১৯ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমিতে প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের প্রত্যাশা করছি।”
আগেভাগেই পাকা আম, বাজারে ভিড়
রাজশাহী জেলার ম্যাংগো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, বিভিন্ন জাতের আম পাড়ার নির্ধারিত সময় নির্ধারিত থাকলেও বাস্তবে এবার সেই সময় মানা হচ্ছে না। ১৫ মে থেকে গুটি, ২২ মে থেকে গোপালভোগ, ২৫ মে থেকে রানিপসন্দ ও লক্ষ্মণভোগ, ৩০ মে থেকে হিমসাগর, ১০ জুন থেকে ল্যাংড়া আম বাজারে আসার কথা থাকলেও ইতিমধ্যেই এসব জাতের আম বাজারে দেখা যাচ্ছে।
বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, কিছু আম গাছেই পেকে গেছে। আবার অনেক আম চাহিদার চাপে আগেভাগেই পেড়ে আনা হয়েছে। দুর্গাপুর এলাকার একজন আড়তদার সোহেল রানা বলেন, “আমি যে বাগান কিনেছি, সেখানে কিছু ল্যাংড়া আম আগেই গাছে পেকে গেছে। তাই সময় হওয়ার আগেই পাড়তে হয়েছে।”
রাজশাহীর বানেশ্বর হাটে সরগরম আমের বেচাকেনা
রাজশাহী বিভাগের সবচেয়ে বড় আম হাট বসে পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বরে। প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে বিকেল পর্যন্ত এই হাট জমে ওঠে। এখানে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার চাষিরা আম নিয়ে আসেন।
গতকাল এই হাটে গিয়ে দেখা যায়, আমচাষি ও পাইকারদের মধ্যে দরকষাকষি চলছে। একদিকে গ্রাম থেকে ভ্যানে করে টাটকা আম এসেছে, অন্যদিকে অনলাইন বিক্রেতা, স্থানীয় পাইকার ও আড়তদাররা কিনে নিচ্ছেন পছন্দসই জাতের আম। এই মৌসুমে কুরিয়ারে আম পাঠানোর জন্য প্যাকেজিং ও পরিবহনের কাজেও ব্যস্ততা লক্ষ্য করা গেছে।
কমেছে আমের দাম, চাষিরা কিছুটা হতাশ
চলতি বছর আমের সরবরাহ বেশি হওয়ায় বাজারে দাম পড়ে গেছে। দুর্গাপুর উপজেলার চাষি আমিনুল ইসলাম জানান, তিনি হিমসাগর আম বাজারে এনেছেন। দাম চাচ্ছেন প্রতি মণ ১ হাজার ৭০০ টাকা, কিন্তু ক্রেতারা ১ হাজার ৫০০ টাকার বেশি দিতে চাইছেন না।
গত বছর এই হিমসাগর আমের দাম ছিল প্রতি মণ ২ হাজার ৬০০ টাকা। তুলনায় এবার তা ১ হাজার টাকা পর্যন্ত কম। আর গোপালভোগ আম বর্তমানে বাজারে বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪০০ টাকা মণ দরে, যা এই মৌসুমে সবচেয়ে বেশি।
ব্যবসায়ী মো. মিটুল বলেন, “এবার আম বেশি, কিন্তু চাহিদা কম। সামনে কোরবানির ঈদ। মানুষ আম কিনবে, নাকি গরু কিনবে? আমি একটা বাগান কিনেছিলাম, দাম না উঠলে লোকসান হবে।”
অনলাইন বিক্রেতারাও ক্ষতির মুখে
রাজশাহীর বানেশ্বর বাজারে পাওয়া গেল ‘সরদার মার্ট’-এর সুরুজ সরদারকে। তিনি অনলাইনে হিমসাগর ও গোপালভোগ আম কেজিপ্রতি ৯৫ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। তার ভাষায়, “আমের পরিমাণ এবার বেশি, দামও কম। তবে কুরিয়ারে পাঠানোর খরচ বেড়ে গেছে। ফলে বাধ্য হয়ে একটু বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।”
আম কিনছেন সাধারণ ক্রেতারাও
এ বছর দাম কম থাকায় সাধারণ ভোক্তারাও আম কিনছেন বেশি করে। মো. সেলিম নামের এক ব্যক্তি হাট থেকে পাঁচ ক্যারেট হিমসাগর আম কিনেছেন। তিনি প্রতিটি ক্যারেট ৮০০ টাকা দরে কিনেছেন, যেখানে প্রতিটি ক্যারেটে রয়েছে ২২ থেকে ২৩ কেজি আম। সেলিম বলেন, “আত্মীয়স্বজনের বাসায় পাঠানোর জন্য কিনেছি। টাটকা আম মিলেছে, দামও তুলনামূলকভাবে কম।”
বৈচিত্র্যময় বাজার, মানভেদে দাম
রাজশাহীর বাজারে বর্তমানে গুটি, গোপালভোগ, হিমসাগর, লক্ষ্মণভোগ, রানিপসন্দ, ফজলি, ল্যাংড়া, আম্রপালি, বারি আম-৪, আশ্বিনা ও গৌড়মতি জাতের আম পাওয়া যাচ্ছে বা শিগগিরই আসবে। এর মধ্যে গুটি আম বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ৮০০ থেকে ১২০০ টাকায়, মানভেদে।
বিভিন্ন জাতের আমের নির্ধারিত বাজারজাতকরণ সময় (রাজশাহী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী):
- গুটি আম: ১৫ মে থেকে
- গোপালভোগ: ২২ মে থেকে
- রানিপসন্দ ও লক্ষ্মণভোগ: ২৫ মে থেকে
- হিমসাগর/ক্ষীরশাপাতি: ৩০ মে থেকে
- ল্যাংড়া ও ব্যানানা ম্যাংগো: ১০ জুন থেকে
- আম্রপালি ও ফজলি: ১৫ জুন থেকে
- বারি আম-৪: ৫ জুলাই থেকে
- আশ্বিনা: ১০ জুলাই থেকে
- গৌড়মতি: ১৫ জুলাই থেকে
- কাটিমন ও বারি আম-১১: সারা বছরই
সামনে ঈদ, চাহিদা কমার শঙ্কা
চলতি মৌসুমে আম পাকছে ঈদের আগেই। এর ফলে ভোক্তার সাধারণ মনোযোগ আম থেকে ঈদকেন্দ্রিক অন্যান্য কেনাকাটায় চলে গেছে। অনেক ব্যবসায়ী মনে করছেন, ঈদের পর আমের বাজার কিছুটা চাঙ্গা হতে পারে।