বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে কি স্থায়ী কমিশন হচ্ছে

দেশের নিত্যপণ্যের বাজারে বারবার মূল্যবৃদ্ধি ও সিন্ডিকেটের প্রভাব ঠেকাতে একটি নতুন ও স্থায়ী কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রস্তাবিত এই সংস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ‘জাতীয় বাজার স্থিতিশীলতা কমিশন (NBSC)’। মূল লক্ষ্য হচ্ছে চাল, ডাল, ডিম, তেল, চিনি, লবণসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ও দামের উপর নজরদারি করে বাজারে স্থিতিশীলতা আনা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই কমিশনের রূপরেখা প্রণয়ন করেছে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি শুধু প্রস্তাবই দেয়নি, বরং কমিশনের কাঠামো ও কার্যক্রম সম্পর্কেও একটি বিস্তারিত রূপরেখা তৈরি করেছে।
২০২৫ সালের ২৩ জানুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ বিষয়টি আলোচিত হয়। সেসময় সচিবের পদ ফাঁকা থাকায় অতিরিক্ত সচিব আবদুর রহিম খানের সভাপতিত্বে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অংশ নেয় জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিনিধি দল।
প্রাথমিক আলোচনার পর কিছুটা সময় প্রকল্পটি স্থগিত থাকলেও, পরবর্তীতে গত ফেব্রুয়ারিতে মাহবুবুর রহমান বাণিজ্যসচিব হিসেবে যোগদান করার পর প্রকল্পটি আবারও গতিশীল হয়। ২০২৫ সালের ১৬ মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চারটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে মতামত চেয়ে চিঠি পাঠায়। সংস্থাগুলো হলো—বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, টিসিবি, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি), এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
তবে প্রথমবার কোনো প্রতিষ্ঠান মতামত না দেওয়ায় ১০ এপ্রিল আবারও স্মারক চিঠি পাঠানো হয়। উভয়বারই কমিশনের রূপরেখা যাচাই করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা, দায়িত্ব এবং প্রস্তাবিত কমিশনের কার্যাবলির মধ্যে কোনো দ্বৈততা রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানানো হয়।
কমিশন গঠনের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা। ভবিষ্যতে এর কার্যক্রম সম্প্রসারিত হলে বাজেটও বাড়তে পারে। বাজেট সংগ্রহে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
টিসিবি ও বিটিটিসির শীর্ষ কর্মকর্তারা এ বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য না করলেও, বিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, বিদ্যমান সংস্থাগুলোকেই শক্তিশালী করে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব। নতুন কমিশনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও প্রস্তাবদাতা প্রতিষ্ঠানটি মনে করছে, বাজার ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরেই অব্যবস্থা ও সিন্ডিকেট বিরাজ করছে, যা জনস্বার্থের জন্য হুমকি।
রূপরেখা অনুযায়ী, নতুন কমিশনের আওতায় থাকবে বাজার তদারকি, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি, অবৈধ মজুত নিয়ন্ত্রণ, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও সিন্ডিকেট দমন। এতে থাকবেন একজন চেয়ারম্যান, একজন নির্বাহী পরিচালক এবং একাধিক সদস্য। কমিশনের সঙ্গে থাকবে পরামর্শক প্যানেল, বাজার বিশ্লেষক দল, আইনি উপদেষ্টা কমিটি এবং ‘ভোক্তা সুরক্ষা বিভাগ’।
কমিশনের উপদেষ্টা কমিটিতে থাকবেন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধি, অর্থনীতিবিদ, কৃষি বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী নেতা এবং ভোক্তা অধিকার প্রতিনিধিরা। এটি সরাসরি বাজারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে এবং নিয়মিত পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে।
রূপরেখায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যারা নিয়মিত ন্যায্য দামে পণ্য বিক্রি করবে তাদের পুরস্কার দেওয়া হবে। আর যারা সিন্ডিকেট বা অবৈধ মজুতের সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের লাইসেন্স বাতিলের পাশাপাশি ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি করা হবে।
তবে কিছু সংশয়ও রয়েছে। যেমন—বাজার স্থিতিশীলতাবিষয়ক কাজের জন্য প্রতিযোগিতা কমিশন উপযুক্ত কি না, এ নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকের মতে, প্রতিযোগিতা কমিশনের কাঠামো ও ক্ষমতা সীমিত, তাই একটি আলাদা ও ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন প্রয়োজন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকের সারসংক্ষেপ থেকে জানা যায়, আলোচনা শুরুতেই স্বাগত জানানো হয়। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের ভেরিফিকেশন কর্মকর্তা ইফতেখার হোসেন চিনি আমদানির খরচ ও বাজারমূল্যের ফারাক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ব্রাজিল থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে আমদানি করা চিনি দেশে বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকায়। একই চিনি ভারতে ৫৩ রুপিতে বিক্রি হয়, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭৫ টাকা। অথচ এখানে দ্বিগুণ দাম।
ছাত্র প্রতিনিধি নিশাত আহমেদ বলেন, হিলি বন্দর দিয়ে আসা পেঁয়াজ নওগাঁয় ৯০ টাকায় বিক্রি হলেও ঢাকায় সেটির দাম ১২০ টাকা, জয়পুরহাটে ১১৫ টাকা। তিনি নিজে জেলা টাস্কফোর্সে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে এ তথ্য দেন।
অপরদিকে, যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ দাউদুল ইসলাম জানান, ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী চিনি আমদানির খরচ পড়ে ১১২ টাকা কেজি, আর বাজারদর টিসিবির হিসাবে ১২৫-১৩০ টাকা। এতে বোঝা যায়, কেউ কেউ অতিরিক্ত মুনাফার জন্য মূল্য বাড়াচ্ছে।
কমিশন গঠনের পক্ষে থাকা ছাত্র প্রতিনিধি আফজালুর রহমান বলেন, প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরও সক্রিয় হতে হবে। জবাবে কমিশনের সদস্য আফরোজা বিলকিস বলেন, তারা চেষ্টা করছেন এবং কার্যক্রম আরও বেগবান করা হবে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে গঠিত হয় ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’। এর সভাপতি হিসেবে আছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ফাউন্ডেশনের সাবেক সিইও মীর মাহবুবুর রহমান জানান, বিষয়টি নিয়ে তার কাছে হালনাগাদ তথ্য নেই। তবে তিনি জানান, ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র প্রতিনিধিদের বিষয়ে তিনি খোঁজ নেবেন।
বর্তমানে বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় সিন্ডিকেট ভাঙা, মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং ভোক্তা স্বার্থ রক্ষা করতে একটি প্রভাবশালী ও কার্যকর কমিশন গঠন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রস্তাবিত ‘জাতীয় বাজার স্থিতিশীলতা কমিশন’ সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছে, যদিও এটি বাস্তবায়ন নির্ভর করবে সরকারি সিদ্ধান্ত ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সম্মতিতে।