চট্টগ্রামের বন্দরে ৩০০ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগ

চট্টগ্রাম বন্দরের তিনটি বড় প্রকল্পে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বা ৩ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজনের মাধ্যমে দেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দর নতুন যুগে প্রবেশ করতে চলেছে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় বিভিন্ন প্রকল্প ঘুরে দেখার পর এই বিনিয়োগ পরিকল্পনার কথা জানান বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)-এর চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী।
এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান, প্রধান উপদেষ্টার উপ–প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এবং বন্দর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
কোন প্রকল্পে কত বিনিয়োগ আসছে?
আশিক চৌধুরীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের তিনটি প্রধান প্রকল্পে নিম্নোক্ত বিদেশি বিনিয়োগ আসার পরিকল্পনা রয়েছে:
- লালদিয়ার চর কনটেইনার টার্মিনাল:
- বিনিয়োগকারী: নেদারল্যান্ডসভিত্তিক এপিএম টার্মিনালস
- সম্ভাব্য বিনিয়োগ: ৬০ থেকে ৮০ কোটি ডলার
- বে টার্মিনাল প্রকল্প:
- বিনিয়োগকারী: সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল ও আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড
- সম্ভাব্য মোট বিনিয়োগ: ২ বিলিয়ন ডলার (প্রতিটি ১ বিলিয়ন করে)
- নিউমুরিং টার্মিনাল:
- ইতোমধ্যে চালু থাকা এই টার্মিনালেও বিদেশি বিনিয়োগের আলোচনা চলছে।
এই প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যে দেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে।
বে টার্মিনাল চালু হবে ২০৩১ সালে, হবে ২৫ হাজার চাকরি
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, “বে টার্মিনাল প্রকল্পটি ২০৩১ সালে চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এটি চালু হলে ২৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং সরাসরি ইউরোপ ও আমেরিকায় কনটেইনারবাহী জাহাজ পাঠানো যাবে।”
বর্তমানে বাংলাদেশকে কনটেইনার আমদানি-রপ্তানির জন্য সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দরের উপর নির্ভর করতে হয়। বে টার্মিনাল চালু হলে এই নির্ভরতা কমে যাবে এবং সময় ও খরচ—দুটিই কমবে।
বিনিয়োগ আকর্ষণে দেশীয় স্বার্থের ওপর জোর
আশিক চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশকে যদি বৈশ্বিক উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, তাহলে বন্দর সুবিধা বাড়াতেই হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আনতে গেলে তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। তবে সবকিছুতেই দেশীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।”
তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে চুক্তি করার সময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ অক্ষুণ্ণ থাকবে, যাতে দেশের বাণিজ্যনির্ভরতা না বাড়ে বরং প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন হয়।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় উঠে এলো বাস্তব চিত্র
চট্টগ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে হোটেল র্যাডিসন ব্লু চট্টগ্রাম বেভিউ-তে এক মতবিনিময় সভায় অংশ নেন আশিক চৌধুরী। সেখানে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা সরাসরি তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
- কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগ ভালো, কিন্তু দেশীয় উদ্যোক্তাদের কথাও গুরুত্ব দিতে হবে। এখনো অনেক কারখানা গ্যাস সমস্যায় ভুগছে।”
- বিএসআরএম গ্রুপের এমডি আমের আলীহুসাইন অভিযোগ করেন, “ঢাকাতেই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমাদের চট্টগ্রাম থেকে ফাইল নিয়ে ঢাকায় ছুটতে হয়, অফিস, বাসা ও পরিবহনও নিতে হয়। ব্যবসা সহজ করতে হলে ঢাকার বাইরে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দিতে হবে।”
- পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমান বলেন, “দেশীয় উদ্যোক্তারাই দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে এনেছেন। তাদের জন্য সহজ শর্তে সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।”
- চট্টগ্রাম নগর জামায়াতের আমির শাহজাহান চৌধুরী প্রশ্ন তোলেন, “নিউমুরিং টার্মিনাল যেখানে অনেক সুবিধা আছে, সেখানে নতুন করে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন কতটা তা বোঝা যাচ্ছে না।”
ফ্রি ট্রেড জোন (মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল) নির্মাণ পরিকল্পনা
আশিক চৌধুরী জানান, চট্টগ্রামে বিমানবন্দর ও বন্দরের সুবিধা কাজে লাগিয়ে একটি ফ্রি ট্রেড জোন গড়ে তোলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে একটি জাতীয় কমিটি সম্ভাব্য প্রকল্প এলাকার ওপর যাচাই-বাছাই করছে।
তিনি বলেন, “মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চীনের অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চট্টগ্রাম একটি বৃহৎ শিল্প-নগরীতে পরিণত হতে চলেছে। আর বন্দরের উন্নয়ন হলে এসব অঞ্চলের কার্যকারিতাও বাড়বে।”