এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খায়রুল আলম চৌধুরীও পদত্যাগ করলেন

দেশের প্রাচীনতম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খায়রুল আলম চৌধুরী হঠাৎ করেই পদত্যাগ করেছেন। গত বৃহস্পতিবার (২ মে) ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের এক বৈঠকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র জমা দেন। দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র আড়াই বছরের মাথায় তাঁর এই সিদ্ধান্ত ব্যাংকিং খাতে নতুন করে আলোচনা ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
২০২২ সালের আগস্ট মাসে তিনি এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার আগে একই পদে ছিলেন মুহাম্মদ এ (রুমী) আলী, যিনি পদত্যাগ করলে খায়রুল আলম চৌধুরী দায়িত্ব পান। উল্লেখযোগ্য হলো, দুজনেই তাঁদের পদত্যাগের কারণ হিসেবে “ব্যক্তিগত কারণ” দেখিয়েছেন।
মোরশেদ খানের ছায়ায় পরিচালনা
এবি ব্যাংক মূলত সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপির নেতা মোরশেদ খানের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্বে পরিচালিত হয়ে আসছে। যদিও গত ১৫ বছরে তিনি ও তাঁর পুত্র ফয়সাল মোরশেদ খান সরাসরি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন না, তবে তাঁদের মনোনীত প্রতিনিধিরাই ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্রিয় ছিলেন।
ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ প্রায় শুরু থেকেই মোরশেদ খানের পরিবারভুক্ত এই গোষ্ঠীর হাতে থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা ও ঋণ আদায়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে, যা প্রশাসনিক পর্যায়ে একাধিক পরিবর্তনের কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এমডি তারিক আফজালের পদত্যাগও সমসাময়িক
চেয়ারম্যানের পদত্যাগের আগেই এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তারিক আফজালও ছুটিতে গিয়ে দেশের বাইরে থেকে পদত্যাগ করেন। এ দুটো পদত্যাগ একই সময়ে হওয়ায় ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
তারিক আফজাল দায়িত্ব পালনকালে ব্যাংকের ডিজিটাল ও করপোরেট সংস্কারের নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর আকস্মিক বিদায় ব্যাংকের রূপান্তর পরিকল্পনায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বড় ঋণখেলাপিরা চাপে ফেলছে ব্যাংককে
এবি ব্যাংকের একাধিক বড় গ্রাহক নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকটি তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে। সবচেয়ে আলোচিত খেলাপি গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে সিকদার গ্রুপ, আশিয়ান সিটি, বিল্ডট্রেড, মাহিন গ্রুপ, আমান গ্রুপ, এরশাদ ব্রাদার্স এবং স্বাস্থ্য খাতে আলোচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া পড়ে থাকা বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণও সময়মতো আদায় করতে পারছে না ব্যাংকটি। সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিয়েছে মোরশেদ খানের মালিকানাধীন সাবেক মোবাইল অপারেটর সিটিসেল থেকে নেওয়া ঋণ আদায় নিয়ে, যা বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে খেলাপি অবস্থায় রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি
এবি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির জটিলতা বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে তাদের একজন প্রতিনিধি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে নিযুক্ত করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে এই ধরনের একাধিক পদত্যাগ নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। খেলাপি ঋণের চাপ, অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক জটিলতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্থবিরতা এই পরিবর্তনের পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে আমাদের ধারণা।”
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে পদত্যাগের প্রভাব
অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতের বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবি ব্যাংকের এই পুনঃপুন নেতৃত্ব পরিবর্তন গ্রাহক আস্থা এবং বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, “ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারকরা যদি ঘন ঘন পাল্টে যান, তাহলে তা আর্থিক স্থিতিশীলতায় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।”
অন্যদিকে, ব্যাংকের শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন হলেও ভবিষ্যতে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য একটি কার্যকর, দক্ষ এবং স্বচ্ছ প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা প্রয়োজন বলে মত দেন তারা।
সামনে কী?
বর্তমানে এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদের জন্য নতুন নাম প্রস্তাব করা হচ্ছে এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। পাশাপাশি ব্যাংকের এমডি নিয়োগেও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে।