এসএমই খাত শুধু ব্যবসা নয়, দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড: শিল্প উপদেষ্টা

দেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। তিনি বলেছেন, এসএমই খাত কেবল একটি ব্যবসায়িক ক্ষেত্র নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এই খাতের উদ্যোক্তারা যে হারে তাদের আয় পুনঃবিনিয়োগ করেন, তা দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিকে জোরদার করতে বড় ভূমিকা রাখছে।
আজ বুধবার রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে অনুষ্ঠিত এক পরামর্শ সভায় এ মন্তব্য করেন শিল্প উপদেষ্টা। সভাটি আয়োজন করে এসএমই ফাউন্ডেশন ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বাংলাদেশ। সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। সভার উদ্দেশ্য ছিল এসএমই নীতিমালা ২০২৫–এর খসড়া নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের মতামত সংগ্রহ করা।
এসএমই খাতের ভূমিকা ও গুরুত্ব
সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে আদিলুর রহমান খান বলেন, “এসএমই খাত দেশের ৩২ শতাংশ অর্থনৈতিক অবদান রাখছে, যা নিঃসন্দেহে বিশাল। ৭৮ লাখের বেশি কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান এই দেশের উন্নয়নে নিরবচ্ছিন্ন অবদান রেখে চলেছে। শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশই এসএমই খাত থেকে আসে, যেখানে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ সরাসরি যুক্ত।”
তিনি আরও বলেন, “এসএমই উদ্যোক্তারা তাঁদের লাভের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পুনরায় ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। এই বিনিয়োগ প্রবণতা প্রমাণ করে যে, এই খাত কতটা প্রতিশ্রুতিশীল এবং টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামো গঠনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।”
পরামর্শ সভায় উপস্থিতির বিশদ বিবরণ
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মুসফিকুর রহমান সভায় সভাপতিত্ব করেন। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে, দেশের ৬৪ জেলায় দেড় লাখের বেশি সিএমএসএমই উদ্যোক্তাকে সরাসরি সেবা দিয়ে আসছে এসএমই ফাউন্ডেশন। এছাড়া, ১১ হাজারের বেশি উদ্যোক্তাকে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, “এসএমই নীতিমালা ২০২৫ বাস্তবায়ন হলে হাজারো সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তা উপকৃত হবেন এবং দেশের অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন।”
সভায় আরও বক্তব্য দেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নূরুজ্জামান ও রশিদুল হাসান, এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, ডিএমডি নাজিম হাসান সাত্তার এবং আইএলও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পৌটিয়াইনেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
আইএলও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পৌটিয়াইনেন বলেন, “বাংলাদেশের এসএমই খাতের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় আমরা বর্তমানে ৩০ লাখ ডলারের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি, যার মাধ্যমে এসএমই খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এসএমই খাতের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে অংশীদারিত্বমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালার প্রয়োজন রয়েছে। আইএলও বাংলাদেশের পক্ষে আমরা এই খাতে উদ্ভাবনী সমাধান ও টেকসই ব্যবসায়িক মডেল নিয়ে কাজ করছি।”
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী সভায় জানান, এসএমই নীতিমালা ২০২৫-এর খসড়া তৈরির সময় ঢাকা ও অন্যান্য বিভাগীয় শহরে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। এসব পরামর্শের ভিত্তিতে চূড়ান্ত খসড়া শিল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে।
এসএমই নীতিমালার লক্ষ্য ও কাঠামো
প্রস্তাবিত এসএমই নীতিমালা ২০২৫-এ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ও দ্রুত ঋণপ্রাপ্তির ব্যবস্থা;
- কর-নীতি সহজীকরণ;
- প্রযুক্তি হস্তান্তর ও ডিজিটাল সক্ষমতা বৃদ্ধি;
- নারী ও যুব উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা;
- বাজার সংযোগ ও রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধি।
এই নীতিমালার মাধ্যমে সরকার প্রত্যাশা করছে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা জাতীয় অর্থনীতির মূলধারায় আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন।
চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ
সভায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জও উঠে আসে, যেমন:
- উদ্যোক্তাদের সচেতনতার ঘাটতি,
- তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে দুর্বলতা,
- ব্যাংকিং সুবিধা গ্রহণে জটিলতা।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুপারিশ করা হয়—উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তি এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর।