বাংলাদেশে প্রতি বছর রমজান মাসকে ঘিরে বাজারে নিত্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। বিশেষত চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল, ছোলা, খেজুর, মসলা, পেঁয়াজ ও রসুনের মতো পণ্যের আমদানি ও সরবরাহ নিয়ে ব্যবসায়ী, ভোক্তা ও সরকারের মধ্যে বাড়তি সতর্কতা লক্ষ্য করা যায়। কারণ, রমজানে এসব পণ্যের চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে—২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে দেশের ভোগ্যপণ্য আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মোট ৯ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ভোগ্যপণ্যের আমদানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৬.৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গড় হিসেবে বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ।
কোন কোন পণ্যের আমদানি বেড়েছে?
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা ৯ ধরনের পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি বেড়েছে মটর ডাল। এ বছর সেপ্টেম্বর–অক্টোবরে মটর ডালের আমদানি বেড়েছে আশ্চর্যজনকভাবে ২৯৪ শতাংশ। এই সময়েই খেজুরের আমদানি বেড়েছে ২৩১ শতাংশ, যা আসন্ন রমজানের বাজার প্রস্তুতির অন্যতম প্রধান লক্ষণ।
এ ছাড়া ডালজাতীয় অন্যান্য পণ্য (মসুর, মুগ, অড়হর ইত্যাদি) আমদানি বেড়েছে ৮৭ শতাংশ,
সয়াবিন তেল বেড়েছে ৩৬ শতাংশ,
আর চিনি বেড়েছে ১১ শতাংশ।
মোট হিসেবে, শুধু দুই মাসেই আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে ১০ লাখ ৮৬ হাজার ৮৬৭ টন পণ্যের জন্য।
অন্যদিকে, গত বছর একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৩০ হাজার ৯৪৬ টন।
এ হিসাবই দেখায়—রমজান সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা এবার বেশি পরিমাণে স্টক নিশ্চিত করতে চাইছেন।
পেঁয়াজ, রসুন ও আদা—তিন পণ্যে আমদানি কমেছে কেন?
যেখানে অধিকাংশ পণ্যের আমদানি বেড়েছে, সেখানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মসলা—পেঁয়াজ, রসুন ও আদা—এর আমদানি কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
পেঁয়াজ আমদানি কমেছে ৯৯%
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী—
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর–অক্টোবরে আমদানি হয়েছে মাত্র ২০৩ টন পেঁয়াজ,
যেখানে গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ২৮ হাজার ৩৭ টন।
অর্থাৎ আমদানি কমেছে ৯৯ শতাংশ।
ব্যবসায়ীদের ব্যাখ্যা—
- দেশে উৎপাদন ভালো হওয়ায় আমদানি কমানো হয়
- ভারত থেকে আমদানির ওপর নির্ভরতা থাকলেও এ বছর সীমিত সময়ের জন্যই অনুমতি দেওয়া হয়েছিল
- স্থানীয় বাজারে অক্টোবর পর্যন্ত দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ ছিল স্থিতিশীল
কিন্তু নভেম্বরের শুরুতে সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিলে দাম দ্রুত বাড়তে শুরু করে, যা নিয়ে বাজারে উদ্বেগ তৈরি হয়।
রসুন কমেছে ৮৯% ও আদা ২২%
স্থানীয় উৎপাদন ও আগের আমদানির মজুত থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা এ বছর রসুন ও আদার আমদানিতে খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে বাজারে দাম ওঠানামার কারণে সরকার এসব পণ্যের ওপরও নজরদারি বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ: এলসি মার্জিন কমছে, বাড়বে আমদানি
১১ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা জারি করে। পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ বজায় রাখতে ১০টি পণ্যের আমদানিতে এলসি খোলার সময় নগদ মার্জিন ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে হবে—এমন নির্দেশ দেওয়া হয়।
যে ১০ পণ্যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে:
- চাল
- গম
- পেঁয়াজ
- ডাল
- ভোজ্যতেল
- চিনি
- ছোলা
- মটর
- মসলা
- খেজুর
নির্দেশনাটি কার্যকর থাকবে ২০২৬ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত।
এর ফলে বাজারে পণ্যের সরবরাহ আরও বাড়বে এবং আশা করা হচ্ছে দামও কিছুটা কমতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকটি সার্কুলারে বলা হয়েছে—৯০ দিনের বাকিতে (usance LC) এসব রমজানের পণ্য আমদানির বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে। এ ধরণের সুবিধা সরাসরি ব্যবসায়ীদের আর্থিক চাপ কমাবে এবং সহজে স্টক গঠনে সহায়তা করবে।
ডলারের সরবরাহ পরিস্থিতি অনুকূলে
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন—
এ বছর আমদানি খাতে ডলারের সরবরাহ তুলনামূলক ভালো অবস্থায় রয়েছে। ফলে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরাও সহজে নিত্যপণ্য আমদানি করতে পারবেন।
এই পরিস্থিতি ইতিবাচক কারণ—
- এলসির চাপ কমবে
- মজুত বাড়বে
- বাজারে ঘাটতির আশঙ্কা কমবে
- রমজানে অস্থিতিশীলতা কমবে
সরকার যদি বাজার তদারকি জোরদার করে, তাহলে কিছু পণ্যের দাম উল্টো কমতেও পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
ব্যবসায়ীদের মতে আমদানির বাড়তি প্রবণতার কারণ
ব্যবসায়ীরা বলছেন—
প্রতিবছর রমজানের আগে পণ্যের চাহিদা ও বাজার ওঠানামা নিয়ে চাপ তৈরি হয়। তাই এবার তারা আগে থেকেই আমদানির দিকে মনোযোগ দিয়েছেন।
তাদের মতে, কয়েকটি বড় কারণ হলো—
১. গত দুই বছর আমদানিতে নানা বাধা ছিল
- উচ্চ এলসি মার্জিন
- ডলারের সংকট
- ব্যাংকের সীমিত অনুমোদন
এগুলো কারণে আগের বছরগুলোতে ব্যবসায়ীরা যারপরনাই চাপে ছিলেন।
২. রমজানে পণ্যের চাহিদা বাড়বে ২০–৩০%
বিশেষত—
- চিনি
- তেল
- ছোলা
- খেজুর
- মসলা
এগুলোর চাহিদা রমজানে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
৩. বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার ভয়
আগে থেকেই স্টক না করলে রমজানে দাম অস্বাভাবিক বাড়তে পারে। তাই ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই আমদানির পরিমাণ বাড়িয়েছেন।
বিশ্লেষণ: রমজান বাজার কি এবার স্থিতিশীল থাকবে?
বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যবসায়ী ও বাজার বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে—এবার রমজানকে সামনে রেখে আমদানি কার্যক্রম ইতিবাচক ধারায় এগোচ্ছে।
মূল কারণগুলো হলো—
- ডলারের সরবরাহ তুলনামূলক স্থিতিশীল
- এলসি মার্জিন কমানো হয়েছে
- সরকারি তদারকি জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা
- ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই স্টক বাড়াচ্ছেন
পরিস্থিতি এভাবে চললে রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা কম বলে মনে করা যায়।
তবে ঝুঁকি আছে তিনটি জায়গায়:
- পেঁয়াজের সরবরাহ – নভেম্বর থেকে ঘাটতি দেখা দিয়েছে
- ডাল ও তেলের আন্তর্জাতিক বাজার – বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে প্রভাব পড়বে
- লজিস্টিক সমস্যা – বন্দর ও পরিবহনের ওপর চাপ বাড়তে পারে
এসব চ্যালেঞ্জ দক্ষভাবে মোকাবিলা করতে পারলে বাজার সম্পূর্ণ স্থিতিশীল থাকবে।
খুচরা বাজারের অবস্থা কী বলছে?
নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পেঁয়াজের দাম বাড়ায় বাজারে চাপ তৈরি হয়। অন্যদিকে তেল, চিনি, ডালের বাজার তুলনামূলক স্থিতিশীল।
ব্যবসায়ীরা বলছেন—
- আমদানির পণ্য স্থানীয় বাজারে আসতে শুরু করলে দাম স্বাভাবিক হবে
- চিনি ও সয়াবিন তেলের আরও কয়েকটি চালান পথে আছে
- ছোলা ও খেজুরের কয়েকটি বড় চালান ডিসেম্বরেই বন্দর ছাড়বে
ভোক্তাদের জন্য পরামর্শ
- ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাজারে নতুন স্টক আসবে
- এই সময়ে বাজার তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকবে
- অযথা বেশি দামে পণ্য কিনবেন না
- বাজারের আপডেট নজরে রাখুন
- সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার তদারকি বাড়লে দাম আরও কমতে পারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য ও গৃহীত নীতিমালা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে—এবার রমজানকে সামনে রেখে দেশের ভোগ্যপণ্য বাজারে ইতিবাচক প্রস্তুতি চলছে। আমদানি বেড়েছে ১৭ শতাংশ, বিশেষত ছোলা, খেজুর, ডাল ও সয়াবিন তেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যে।
এছাড়া এলসি মার্জিন কমানো, ডলার সরবরাহ উন্নত থাকা এবং ব্যাংকের নতুন সুবিধা ব্যবসায়ীদের আরও সক্রিয় করেছে।
ফলে এবারের রমজানে বাজারে পণ্যের ঘাটতি বা অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি কম বলে আশা করা যায়।
MAH – 13853 I Signalbd.com



