বাংলাদেশ

বিমান বিধ্বস্ত: ‘যারা মারা গেছে তাদের শরীর পুড়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে’

Advertisement

 উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় হৃদয়বিদারক চিত্র উঠে আসছে। হাসপাতালে স্বজনদের কান্না, পোড়া শরীরের চিহ্ন, এবং শনাক্তহীন দেহগুলো নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভীষিকাময় এক পরিস্থিতি।

ভয়াবহতার চিত্র: পোড়া শরীর, অজ্ঞাত পরিচয়

উত্তরার দিয়াবাড়িতে সোমবার দুপুরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিধ্বস্ত হলে ২০ জন নিহত হন এবং আহত হন শতাধিক। তবে এরচেয়েও মর্মান্তিক ছিল দুর্ঘটনার পরবর্তী দৃশ্য।

বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিএমএইচ-এ আহতদের নেওয়া হলে দেখা যায়—অনেক মরদেহ এতটাই পুড়ে গেছে যে চেনার কোনো উপায় নেই।

একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “যারা মারা গেছে তাদের শরীর পুরোপুরি পুড়ে গেছে। অনেকে শুধু কঙ্কাল হয়ে গেছে। এটা চোখে দেখা যায় না ভাই।”

হাসপাতালের গেটের সামনে শত শত অভিভাবক তাদের নিখোঁজ সন্তানদের খোঁজে আহাজারি করছিলেন। কারো হাতে ছিল পোড়া জামার একটি টুকরো, কেউ খুঁজছিল স্কুলব্যাগ দেখে সন্তান চিনতে পারছে কিনা।

ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ

বিকেল ১টা ৫ মিনিটে একটি প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইলস্টোন স্কুলের ভবনের নিচ তলায় ঢুকে পড়ে। মুহূর্তেই বিস্ফোরণ ঘটে এবং আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো নিচ তলায়।

সেই সময় স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল, তবে কোচিং ক্লাস চলছিল। মাঠে ও নিচতলায় খেলছিল ছোটরা। ফলে নিহতদের বেশিরভাগই প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে।

বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস দ্রুত উদ্ধার কাজে নামে। কিন্তু যেসব শিশু সামনের দিকে ছিল, তাদের অনেকেই ঘটনাস্থলেই দগ্ধ হয়ে মারা যায়।

হাসপাতালের চিত্র: কান্না, আতঙ্ক ও পরিচয় সংকট

দুর্ঘটনার পর সবচেয়ে বেদনাদায়ক দৃশ্য দেখা গেছে হাসপাতাল চত্বরে। স্বজনরা ছোটাছুটি করছিলেন, কারো মুখে শুধু একটাই প্রশ্ন—“আমার সন্তান কই?”

বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, “অনেক মরদেহ এমন অবস্থায় এসেছে যে শনাক্ত করা কঠিন। পোড়া শরীরের চামড়া খুলে গেছে, অনেক সময় হাড় দেখা যাচ্ছে।”

এছাড়া অনেক আহত শিশু কথা বলার অবস্থায় নেই। শ্বাসনালী পুড়ে গেছে, শরীরের ৭০%–৮০% পুড়ে গেছে অনেকের।

একজন শিক্ষার্থী বলেন, “আমার পাশেই ছিল রাফি। হঠাৎই বিস্ফোরণ হলো, ও চিৎকার করল। তারপর ওকে আর দেখি নাই।”

পরিচয়হীন দেহ: চ্যালেঞ্জে প্রশাসন

আইএসপিআর সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত অন্তত ৭টি মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তাদের দেহ পুড়ে এমন অবস্থায় রয়েছে যে ডিএনএ টেস্ট ছাড়া পরিচয় পাওয়া যাবে না।

ঢাকা জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ছবির মাধ্যমে শনাক্তের চেষ্টা করছি, তবে অনেক ক্ষেত্রে তা সম্ভব হচ্ছে না। স্বজনদের ডিএনএ নমুনা নিচ্ছি।”

এদিকে, অনেক বাবা-মা সন্তানকে খুঁজে না পেয়ে হাসপাতালে অবস্থান নিয়েছেন, রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন শনাক্তের কোনো সম্ভাবনায়।

আগুনের ভয়াবহতা ও উদ্ধার বাধা

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিমানটি ভবনে ঢোকার পরপরই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। মুহূর্তেই আগুন পুরো নিচতলায় ছড়িয়ে পড়ে।

ফায়ার সার্ভিসের একজন সদস্য বলেন, “আমরা ঢোকার চেষ্টা করলেও আগুনের তীব্রতা বেশি ছিল। ভেতরে অনেকেই পড়ে ছিল, কিন্তু আগুনের কারণে কাছে যাওয়া যাচ্ছিল না।”

এছাড়া, স্কুল ভবনের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা কার্যকর ছিল না। এতে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায় বলে মনে করছেন উদ্ধারকর্মীরা।

শিশুদের বর্ণনায় বিভীষিকাময় সময়

বেঁচে যাওয়া অনেক শিশু জানিয়েছে, তারা দুর্ঘটনার সময় ক্লাসে ছিল বা মাঠে খেলছিল। হঠাৎ বিকট শব্দে বিল্ডিং কেঁপে ওঠে, তারপর ধোঁয়া, আগুন আর চিৎকার।

একজন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী বলে, “আমরা নিচে নেমে দেখলাম চারপাশে ধোঁয়া। কেউ পড়ে আছে, কেউ দৌড়াচ্ছে। আমি ভয় পেয়ে একটা বেঞ্চের নিচে লুকিয়েছিলাম।”

তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, অনেক সময় স্কুলের গেট বন্ধ ছিল, ফলে অনেকে বের হতে পারেনি। পরে সেনাবাহিনী এসে উদ্ধার করে।

বিশ্লেষণ ও নিরাপত্তা প্রশ্ন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশিক্ষণ বিমানের রুট নির্বাচন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এমন দুর্ঘটনা হয়েছে। জনবহুল এলাকার ওপর দিয়ে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট নিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি।

বিমান বাহিনীর একজন সাবেক কর্মকর্তা বলেন, “শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর দিয়ে এই ধরনের উচ্চ গতির প্রশিক্ষণ ফ্লাইট কেন চালানো হয়, তা তদন্তের বিষয়। এ ঘটনায় অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।”

স্বজন হারানোর বেদনা কি কখনো মিটবে?

এই দুর্ঘটনা শুধু একটি প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং একটি মানবিক ট্র্যাজেডি। যে মা সন্তানের পোড়া জামা হাতে করে হাসপাতালের গেটের সামনে বসে আছেন, তার কাছে এই ব্যর্থতার ভাষা নেই।

প্রশাসনের উচিত সর্বোচ্চ তদন্ত এবং দোষীদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য আর কখনো দেখতে না হয়।

এম আর এম – ০৪৫৭, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button