বাংলাদেশে মুরগির বাচ্চার উৎপাদন গত এক বছরে প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে চাহিদা মাত্র ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে মুরগির বাচ্চার মূল্য ব্যাপকভাবে নিম্নমুখী। বর্তমানে এক দিনের মুরগির বাচ্চার দাম ১০ থেকে ২০ টাকার মধ্যে, যেখানে উৎপাদনের খরচ ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত। এতে করে দেশজুড়ে হ্যাচারির মালিকরা বড় ধরনের লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন।
মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে অতিরিক্ত সরবরাহ, দাম ধসে ১০-২০ টাকায়
গত বছরের তুলনায় এক দিনের মুরগির বাচ্চার দাম সর্বোচ্চ ৯০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত ওঠার পর হঠাৎই দাম এখন ১০ থেকে ২০ টাকায় নেমে এসেছে। মুরগির বাচ্চার উৎপাদন বাড়ানোর জন্য হ্যাচারিগুলো বিনিয়োগ বাড়ালেও চাহিদা বৃদ্ধি তা অনুসরণ করেনি। ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগির চাহিদা প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ হলেও উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ২ কোটি বাচ্চা। অন্যদিকে সোনালি ও রঙিন জাতের বাচ্চার উৎপাদন আড়াই কোটি ছাড়িয়েছে, যেখানে চাহিদা মাত্র ২ কোটি ১০ লাখ।
উৎপাদন চাহিদার তুলনায় প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হওয়ায় বাজারে মুরগির বাচ্চার মূল্য ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে।
উৎপাদন খরচ ও মূল্য পার্থক্যে বড় লোকসান
হ্যাচারি মালিকরা জানান, বর্তমানে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা খরচ পড়ছে। অথচ বাজারে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০ থেকে ২০ টাকায়। সরকার নির্ধারিত মূল্য ছিল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা, কিন্তু তা বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। একইভাবে লেয়ার বাচ্চার উৎপাদন খরচ প্রায় ৪৭ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়। সোনালি জাতের মুরগির বাচ্চার উৎপাদন খরচ ২০ থেকে ৩০ টাকা হলেও বাজার মূল্য নেমে গেছে ১০ থেকে ১৫ টাকায়।
প্ল্যানেট এগ লিমিটেডের পরিচালক শাহ ফাহাদ হাবিব জানান, তাদের মাসিক উৎপাদন প্রায় ১০ লাখ বাচ্চা। গড়ে ৪৫ টাকা খরচ হলেও বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়, যার ফলে মাসে প্রায় আড়াই কোটি টাকা লোকসান হচ্ছেন।
ছোট ও মাঝারি হ্যাচারি বন্ধ হওয়ার শঙ্কা
দামের এমন হ্রাসের কারণে অনেক ছোট ও মাঝারি হ্যাচারি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। বিএবির সাধারণ সম্পাদক শাহ ফাহাদ হাবিব বলছেন, উৎপাদনের অতিরিক্ত সরবরাহ এবং দাম কম থাকার কারণে খাতটি সংকটে পড়েছে। ছোট হ্যাচারি গুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যা দেশের মুরগি শিল্পের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
হ্যাচারির মালিক ও খামারিদের মধ্যে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ের অভাবও সমস্যা বাড়িয়েছে। অনেক বড় প্রতিষ্ঠান হয়তো ছোটদের ব্যবসা থেকে সরিয়ে দিতে ইচ্ছাকৃতভাবে অতিরিক্ত উৎপাদন করছেন বলে ধারণা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
সমাধানে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ
হ্যাচারিমালিকরা সরকার, খামারি ও সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যা প্রতি তিন মাস পরপর মুরগির বাচ্চার চাহিদা ও উৎপাদন পর্যালোচনা করবে। এ ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং উৎপাদন খরচের সঙ্গে বিক্রির মূল্য সামঞ্জস্য করা সম্ভব হবে।
মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের জটিল প্রক্রিয়া
মুরগির বাচ্চা উৎপাদন শুরু হয় বিদেশ থেকে আনা জিপি (গ্র্যান্ড প্যারেন্ট) মুরগি থেকে। জিপি থেকে পিএস (প্যারেন্ট স্টক) উৎপাদিত হয়, যা থেকে নিয়মিত ডিম পাওয়া যায়। এই ডিম থেকে এক দিনের বাচ্চা মুরগি উৎপাদিত হয়। দেশের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ ব্রয়লার বাচ্চার বাজার।
সরকারি খামার ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভূমিকা
দেশে সরকারি মুরগির খামার ২৮টি, যার মধ্যে ১৫টি খামারে বাচ্চা উৎপাদন হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারি খামার থেকে মোট ৩৮ লাখ বাচ্চা উৎপাদিত হয়েছে। সরকারি খামারের মুরগির বাচ্চার দাম ১২ থেকে ১৫ টাকা। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বাজারে মুরগির বাচ্চার দাম অস্বাভাবিক কমে যাওয়ার কারণ খতিয়ে দেখতে ও সমাধানের জন্য কাজ করছে।
খামারিরা লাভ করতে পারছেন না, বাজার সংকট গভীর হচ্ছে
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক শাকিলা ফারুক বলেন, অতিরিক্ত সরবরাহ ছাড়াও ফিড ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি, কম দাম এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে খামারিরা লাভ করতে পারছেন না। অনেক খামারি লোকসানে থাকায় ব্যবসা থেকে সরে আসছেন, যা চাহিদা কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ।
বাজারে দামের নিয়ন্ত্রণে সরকারী পদক্ষেপ জরুরি
বিভিন্ন খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন দামের স্থায়িত্ব, উৎপাদনের সুষম নিয়ন্ত্রণ এবং খামারি ও হ্যাচারির জন্য সহায়তা। হ্যাচারি মালিকেরা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন যাতে উৎপাদন ও বাজারের ভারসাম্য বজায় থাকে, এবং ক্ষুদ্র খামারি ও হ্যাচারির অবস্থা রক্ষা পায়।
বাংলাদেশের মুরগি শিল্প এখন একটি সংকটময় পর্যায়ে পৌঁছেছে। অতিরিক্ত উৎপাদন, কম চাহিদা, উচ্চ উৎপাদন খরচ এবং নিম্ন বাজার মূল্য মিলিয়ে খাতটি বড় ধরনের লোকসান ও অস্থিরতার মুখে পড়েছে। এর সমাধানে প্রয়োজন সকল স্টেকহোল্ডারের সমন্বিত উদ্যোগ ও সরকারের কার্যকর নীতিমালা। তবেই প্রাণিসম্পদ খাতের স্থায়িত্ব নিশ্চিত হবে এবং খামারি-হ্যাচারি ব্যবসায়ীরা স্বস্তিতে কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন।



