রাজনীতি

সাদিক কায়েমের মামলা, ছাত্রদলের তীব্র নিন্দা

Advertisement

বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে আবারও তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েমকে ঘিরে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কয়েকটি আইডি ও পেজের বিরুদ্ধে তার দায়ের করা মামলাকে ঘিরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এ বিষয়ে ছাত্রদলের পক্ষ থেকে বিস্তারিত লিখিত বিবৃতিও প্রকাশ করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়—এই মামলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক। ছাত্রদল দাবি করে, সাইবার সুরক্ষা আইন বাতিলের পর প্রবর্তিত নতুন বিধান অনুযায়ী অনেক অভিযোগই আর ফৌজদারি অপরাধের আওতায় পড়ে না; তাই এমন মামলাকে তারা ‘হয়রানিমূলক’ হিসেবে দেখছে।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে, বিশেষ করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন করে বাকস্বাধীনতা-সংক্রান্ত আলোচনা জোরদার হয়েছে।

ছাত্রদলের বিবৃতিতে কী আছে

ছাত্রদলের পাঠানো বিবৃতিতে তুলে ধরা হয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ—
তাদের ভাষ্যমতে,

  • সাদিক কায়েম কিছু ফেসবুক আইডি ও পেজের বিরুদ্ধে ‘বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও হয়রানিমূলক’ অভিযোগ এনে মামলা করেছেন।
  • মামলাটি শিক্ষার্থীদের ওপর অনলাইন ভীতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে করা হয়েছে বলে ছাত্রদলের দাবি।
  • বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সাইবার সুরক্ষা আইনের আওতায় যেসব বিষয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়, অভিযুক্ত কর্মকাণ্ড তার মধ্যে পড়ে না।
  • ছাত্রদলের বক্তব্য, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পূর্ববর্তী সময়ের বিভিন্ন কঠোর সাইবার আইন বাতিল করে মতপ্রকাশের অধিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। তাই মামলার এ উদ্যোগ ‘আইনের অপব্যবহার’।

ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির জানান, “এই মামলা শিক্ষার্থীদের ভয় দেখানোর প্রচেষ্টা। মামলা প্রত্যাহার করে সাদিক কায়েমকে ক্ষমা চাওয়ার মানসিকতা প্রদর্শন করতে হবে।”

সাদিক কায়েমকে ঘিরে অতীতের বিতর্ক

ছাত্রদলের বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, অতীতে ফেসবুকে একটি পোস্টে সাদিক কায়েম ব্যক্তিগত অভিযোগ তুলেছিলেন, যা পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি করে। ছাত্রদলের ভাষ্য—তার অনুসারী কিছু প্রোফাইল বা পেজ নানান বিতর্কিত ক্রিয়াকলাপে যুক্ত থাকায় অনলাইন সাইবার পরিবেশে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।

যদিও এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা হয়নি, সংবাদপরিসরে এসব বক্তব্যকে সম্পূর্ণরূপে ছাত্রদলের দাবি হিসেবেই তুলে ধরা হচ্ছে।

সাইবার সুরক্ষা আইন: কোন ধারায় কী আছে?

যেহেতু ঘটনাটি সাইবার আইনের আওতায় মামলা সংক্রান্ত, তাই বিষয়টি বোঝার জন্য আইনের কিছু প্রাসঙ্গিক ধারা শিক্ষার্থী সমাজে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

বাংলাদেশে পূর্বে প্রচলিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) সমালোচিত হওয়ার পর এটি বাতিল করে সংশোধিত রূপে সাইবার সুরক্ষা আইন প্রবর্তন করা হয়। এই আইনে—

  • মানহানির মতো অপরাধকে সাধারণত দেওয়ানি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে,
  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশের জন্য আগের তুলনায় কঠোরতা অনেক কমানো হয়েছে,
  • মিথ্যা অভিযোগ করলে মামলাকারীর বিরুদ্ধেও শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে (ধারা ২৮)।

এই ধারার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কেউ জেনেশুনে মিথ্যা মামলা করলে বা অপরাধ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলে, অভিযোগকারী নিজেই আইনগত জবাবদিহির মুখে পড়তে পারেন।

ছাত্রদলের দাবি—সাদিক কায়েম যে অভিযোগ এনেছেন, তা এই আইনের অধীনে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না। তবে সাদিক কায়েম এখন পর্যন্ত মামলার বিষয়ে বিস্তারিত কোনো জনসম্মুখ বিবৃতি দেননি; ফলে তার অবস্থান জানা যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে দীর্ঘদিনের আলোচনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের রাজনৈতিক চর্চার কেন্দ্র বলা হলেও এখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বহুবার বিতর্ক হয়েছে।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়—

  • বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থী সংগঠনের পক্ষ থেকে সমালোচনামূলক পোস্ট বা মিম প্রকাশ করলে অন্য পক্ষ মামলা বা অভিযোগ করার চেষ্টা করেছে,
  • অনলাইন প্ল্যাটফর্মে শিক্ষার্থীদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বা সমালোচনা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে,
  • সহনশীলতা, পরস্পরের মতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অনলাইনে দায়িত্বশীল আচরণ নিয়ে শিক্ষকদের পক্ষ থেকেও নিয়মিত আহ্বান জানানো হয়।

সাদিক কায়েমের সাম্প্রতিক মামলা এই দীর্ঘ বিতর্ককে আরও তীব্র করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সমাজে প্রতিক্রিয়া

ঘটনাটির পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু শিক্ষার্থীর মন্তব্য থেকে দেখা যায়—
অনেকে মনে করছেন এই মামলা অযৌক্তিক, আবার কেউ কেউ দাবি করেন অনলাইনে ব্যক্তিগত আক্রমণ, অপমান বা বিদ্বেষমূলক সামগ্রী বন্ধ করতে আইনগত ব্যবস্থা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা জানান—যেকোনো নাগরিক মামলা করতে পারেন; তবে মামলাটি গ্রহণযোগ্য কি না, তা আদালতই ঠিক করবেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি দায়িত্বশীল আচরণও সমান প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আইন, নৈতিকতা ও শিক্ষার্থীসুলভ আচরণ—তিনটির ভারসাম্য জরুরি।

ছাত্ররাজনীতিতে মামলা ও পাল্টা মামলার প্রবণতা

বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতিতে প্রায়ই দেখা যায়—
এক পক্ষ অভিযোগ করলে অন্য পক্ষ বিবৃতি দেয়, পাল্টা অভিযোগ ওঠে, কখনও মামলা পর্যন্ত গড়ায়।

এই সংস্কৃতি শিক্ষাঙ্গনে উত্তেজনা তৈরি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে—

  • রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্বের প্রভাব ছাত্র সংসদে চলে আসে,
  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারে উত্তেজনা আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে,
  • বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক সমাজকে আরও সক্রিয় ও দায়িত্বশীল হতে হয়।

সাদিক কায়েমকে ঘিরে এই মামলাও একই ধারাবাহিকতার অংশ বলে অনেক বিশ্লেষকের মত।

বিবৃতির আহ্বান: মামলা প্রত্যাহার ও ক্ষমা প্রার্থনা

ছাত্রদল তাদের বিবৃতির শেষে সাদিক কায়েমকে মামলা প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়। তারা মনে করে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হওয়াই উত্তম পথ।

সংগঠনটি দাবি করে, বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে মতবিরোধ থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। তবে তা যেন সহনশীলতার মধ্যে থাকে, ছাত্রসমাজ যেন হয়রানি বা ভয়ভীতির মধ্যে না পড়ে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও দায়িত্ব—দুই পক্ষকেই সতর্ক থাকতে হবে

যদিও ছাত্রদল মামলাটির নিন্দা জানিয়েছে, তবুও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে অনেকেই মনে করেন—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপব্যবহারও প্রতিদিনই বাড়ছে।
ফলে প্রয়োজন—

  • শিক্ষার্থীদের দায়িত্বশীল ব্যবহার,
  • ব্যক্তিগত আক্রমণ বা বিদ্বেষমূলক কনটেন্ট এড়িয়ে চলা,
  • সত্যতা যাচাই করে মন্তব্য করা,
  • রাজনৈতিক বিরোধকে ব্যক্তিগত বিদ্বেষে রূপ না দেওয়া।

একই সঙ্গে মামলা–হয়রানি বা ভয় সৃষ্টির অভিযোগ থাকলে তা খতিয়ে দেখাও জরুরি।

সাদিক কায়েমের মামলাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল যে নিন্দা জানিয়েছে, তা দেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির জটিল বাস্তবতাকে আবার সামনে এনেছে।
বক্তব্য–মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, অনলাইন আচরণবিধি, সাইবার আইন ও শিক্ষার্থীদের অধিকার—সবকিছুই নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

সংলাপ, সহনশীলতা, পরস্পরের প্রতি সম্মান—এগুলো ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন তার প্রকৃত মুক্ত রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক পরিবেশ ফিরে পাবে না—এমনটাই মনে করেন নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা।

এই ঘটনার পর এখন সবার নজর থাকবে—
মামলাটি আদৌ আদালতের প্রাথমিক পরীক্ষায় টিকে থাকে কি না এবং দুই পক্ষ শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনায় যেতে পারে কি না।

MAH – 14093 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button