বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘সনদ’ ও ‘গণভোট’ নিয়ে যে আলোচনা চলছে, তা নিয়ে সরাসরি প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, “আপনারা কি সনদ ও গণভোট বোঝেন? আমি নিজেও বুঝি না।”
রবিবার দুপুরে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। নিজের সংসদীয় আসনে নির্বাচনি প্রচারণার অংশ হিসেবেই এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।
সাধারণ মানুষের বাস্তবতা তুলে ধরে ফখরুলের বক্তব্য
মির্জা ফখরুল বলেন, “দেশের মানুষ এখন একটাই জিনিস বোঝে—নিজের ভোটের অধিকার। তারা চায় নিজের হাতে ভোট দিতে, নিজের পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নিতে। কিন্তু দেশে এখন ভোট মানেই নাটক। কিছু শক্তি দেশকে গণতন্ত্রের পথ থেকে সরিয়ে দিতে চায়।”
তিনি আরও বলেন, “এখন দেশে কয়েকটি রাজনৈতিক দল সনদ ও গণভোটের কথা বলছে। আমরা বলেছি, যদি গণভোট হয়, তাহলে তা জাতীয় নির্বাচনের সময়েই হোক। তবে সাধারণ মানুষ এসব বোঝে না। সনদ আর গণভোটের বিষয়টা আসলে যারা উচ্চশিক্ষিত, নীতিনির্ধারক শ্রেণির মানুষ, তারাই বোঝে। গ্রামের মানুষ বোঝে ভোট, বোঝে উন্নয়ন, বোঝে ন্যায্যতা।”
মির্জা ফখরুলের অভিযোগ, “আমেরিকা থেকে কিছু লোক এসে আমাদের ওপর এই গণভোট ও সনদের চাপ দিচ্ছে। অথচ দেশের মানুষ এসব চায় না। তারা শুধু চায়—একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।”
‘হাসিনার মনে দরদ নেই’—ফখরুলের কড়া সমালোচনা
বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে ফখরুল বলেন, “হাসিনার মনে দেশের মানুষের প্রতি কোনো দরদ নেই। যদি সত্যিকারের দরদ থাকতো, তাহলে তিনি দলের কর্মীদের ছেড়ে পালাতেন না, তাদের অসহায় অবস্থায় ফেলে রাখতেন না।”
তিনি আরও বলেন, “দলকে ক্ষমতায় রাখতে গিয়ে শেখ হাসিনা গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন। আজ দেশের মানুষ ভয়ে কথা বলতে পারে না, মিছিল করতে পারে না, ভোট দিতে পারে না। এই অবস্থায় আর চলতে দেওয়া যায় না।”
‘১৯৭১-এর গণহত্যা ও ২০২৪-এর আন্দোলনের দমন একই ধরণের’
মির্জা ফখরুল বলেন, “১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল। তারা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গুলি চালিয়েছিল। ২০২৪ সালেও আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো হয়েছে। দুটোই গণহত্যা। এবার শেখ হাসিনার নির্দেশেই গুলি চালানো হয়েছিল।”
তিনি দাবি করেন, “যেভাবে পাকিস্তানিরা ৭১ সালে দেশপ্রেমিকদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল, সেভাবেই বর্তমান সরকার আন্দোলনকারীদের দমন করেছে। মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে, গুম করা হয়েছে।”
নির্বাচনের আহ্বান ও নিজের রাজনৈতিক যাত্রা
নিজের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ফখরুল বলেন, “আমি ১৯৯১ সাল থেকে নির্বাচন করছি। কখনও জিতেছি, কখনও হেরেছি। কিন্তু আমি কখনও ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষকে ছেড়ে যাইনি। গত ১৫ বছর আমরা ভোট করতে পারিনি, কারণ সরকার আমাদের সুযোগ দেয়নি।”
তিনি স্থানীয়দের উদ্দেশে বলেন, “আগামী নির্বাচন সামনে। এবার আপনারা আপনাদের মানুষকে ভোট দিন। বিএনপি সবসময় আপনাদের পাশে থেকেছে, আপনাদের অধিকার ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে।”
‘দেশ এখন সংকটে, মানুষ মুক্তি চায়’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “দেশ এখন ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটে। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন—সবই এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। তারা চায় একটা পরিবর্তন, চায় মুক্তি।”
তিনি আরও বলেন, “দেশে এখন গণতন্ত্র নেই, নেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। সাংবাদিকরা ভয় পায় সত্য বলতেও। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।”
‘বিদেশি চাপ নয়, জনগণের ভোটই চায় বিএনপি’
সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক চাপ নিয়ে বিএনপি’র অবস্থান স্পষ্ট করে ফখরুল বলেন, “আমরা বিদেশি চাপ চাই না, বিদেশি সনদও চাই না। আমরা চাই বাংলাদেশের মানুষ নিজের হাতে নিজের ভাগ্য নির্ধারণ করুক। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনুক। বিদেশিরা নয়, জনগণই আমাদের শক্তি।”
তিনি বলেন, “আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই দেশকে স্বাধীনতার চেতনায় দাঁড় করিয়েছিলেন। আজ আমরা সেই চেতনা ফিরিয়ে আনতে চাই।”
ঠাকুরগাঁওবাসীর সঙ্গে হৃদয়ের বন্ধন
বক্তব্যে বারবার নিজের এলাকার মানুষের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটান ফখরুল। তিনি বলেন, “আমি আপনাদের ঘরের ছেলে। সুখে-দুঃখে সবসময় পাশে থেকেছি। যখন ভোট দিতে পারিনি, তখনো আপনাদের কথা ভেবেছি। এবার যদি সুযোগ আসে, আমি ঠাকুরগাঁওয়ের উন্নয়নে নতুন অধ্যায় শুরু করতে চাই।”
তিনি ঠাকুরগাঁওয়ের উন্নয়ন নিয়ে বলেন, “আমাদের কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না, তরুণরা কাজ পাচ্ছে না, চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এই বাস্তবতা পাল্টাতে হলে সরকারের পরিবর্তন দরকার।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ: ফখরুলের বক্তব্যের প্রভাব
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মির্জা ফখরুলের এ বক্তব্য মূলত বিএনপির আসন্ন নির্বাচনের কৌশলিক প্রস্তুতির অংশ। তিনি মাঠপর্যায়ে জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে দলের অবস্থান পরিষ্কার করতে চাইছেন।
তাদের মতে, “সনদ” ও “গণভোট” প্রসঙ্গটি আসলে বর্তমান সরকার ও আন্তর্জাতিক মহলের আলোচনার অংশ, কিন্তু বিএনপি এটি জনমানুষের ভাষায় নামিয়ে আনছে। এর মাধ্যমে দলটি বোঝাতে চাইছে, তারা বিদেশি চাপ নয়, জনগণের ভোটের রাজনীতিতেই বিশ্বাসী।
মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের সারমর্ম হলো—বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে। জনগণ পরিবর্তন চায়, তারা ভোটের অধিকার ফিরে পেতে চায়। বিএনপি সেই দাবির প্রতিনিধিত্ব করতে চায়।
তিনি বলেন, “দেশের মানুষ সনদ বা গণভোট চায় না, তারা চায় নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই নির্ধারণ করতে। সেই সুযোগই দিতে চায় বিএনপি।”
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁওয়ের মতবিনিময় সভায় বলেছেন, সাধারণ মানুষ সনদ বা গণভোট বোঝে না—তারা শুধু নিজের ভোটের অধিকার চায়। শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করে তিনি বলেন, জনগণের মুক্তি ও পরিবর্তনের একমাত্র পথ হলো সুষ্ঠু নির্বাচন।
MAH – 13708 I Signalbd.com



