যান্ত্রিক ত্রুটির শিকার হওয়ার পর বিমানটি জনবসতি এড়িয়ে নিরাপদ স্থানে নেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টায় ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়নি। দুর্ঘটনায় বহু হতাহত।
ভয়াবহ দুর্ঘটনার মূল ঘটনা
ঢাকার উত্তরা দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে সোমবার দুপুরে বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীসহ বহু মানুষ আহত ও নিহত হন।
দুপুর ১টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলা এ কে খন্দকার ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে বিমানটি। উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি লক্ষ্য করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এড়িয়ে তুলনামূলক ফাঁকা স্থানে বিমানটি অবতরণের উদ্যোগ নেন।
তবে শেষ মুহূর্তে বিমানটি উত্তরার দিয়াবাড়িতে অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুলের দোতলা একটি ভবনে আছড়ে পড়ে। বিস্ফোরণ এবং আগুনে হতাহত হন অনেকেই।
পাইলটের সাহসিকতা: দুর্ঘটনার আগেও চেষ্টার অন্ত ছিল না
বাংলাদেশ আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে জানায়, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এবং জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম তাঁর সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালান।
তাঁর এই দ্রুত ও সাহসী সিদ্ধান্তে রাজধানীর একাধিক জনবহুল এলাকা বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে বলেও জানায় বিমান বাহিনী।
প্রত্যক্ষদর্শীরাও জানিয়েছেন, বিমানটি হঠাৎ করেই নিচের দিকে নামতে থাকে এবং শোঁ শব্দে দ্রুত নেমে আসে। তবে সেটি জনবহুল রাস্তায় না পড়ে একপাশের স্কুল ভবনের কাছে পড়ে — যেখানে কিছুটা ফাঁকা জায়গা ছিল।
কেন ছিল এই ফ্লাইট?
বিমানটি ছিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এফটি-সেভেন বিজিআই মডেলের একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। এটি নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবেই কুর্মিটোলা ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করেছিল।
প্রশিক্ষণ চলাকালীন এ ধরনের যুদ্ধবিমান থেকে পাইলটরা কৌশল, দিক পরিবর্তন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং জরুরি অবতরণ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকেন।
এই প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির উড্ডয়নের পরপরই যান্ত্রিক সমস্যা চিহ্নিত করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে নিজেই বিপদ থেকে মুক্তির পরিকল্পনা হাতে নেন।
দুর্ঘটনার পর ক্ষয়ক্ষতি ও উদ্ধার কাজ
আইএসপিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, এই দুর্ঘটনায় পাইলটসহ ১৯ জন নিহত হয়েছেন এবং ১৬০-এর বেশি মানুষ আহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং আশপাশের লোকজন রয়েছেন।
দুর্ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি আহতদের সিএমএইচ ও অন্যান্য হাসপাতালে দ্রুত পাঠানো হয়।
স্থানীয় বাসিন্দারাও উদ্ধারে অংশ নেন এবং রক্ত দিয়ে সহায়তা করেন। আহতদের মধ্যে অনেকেই বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।
জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া ও পাইলট তৌকিরকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রশংসা
এই মর্মান্তিক ঘটনায় দেশজুড়ে শোক ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই দুর্ঘটনার জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
পাশাপাশি প্রশংসা পেয়েছেন পাইলট তৌকির ইসলাম — যিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন যেন সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচানো যায়। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামজুড়ে তাঁকে ‘সাহসী দেশপ্রেমিক’ বলে সম্মান জানানো হচ্ছে।
একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন,
“নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি অন্যদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। তৌকির আমাদের হিরো।”
নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি?
এই দুর্ঘটনার পর অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান ওড়ানোর অনুমতি কতটা যুক্তিযুক্ত? কেন বিমানটির যান্ত্রিক ত্রুটি আগে ধরা পড়েনি?
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধবিমান বা প্রশিক্ষণ বিমানের ফ্লাইট রুট নির্ধারণে অধিক সতর্কতা প্রয়োজন। বিশেষ করে যেখানে স্কুল, হাসপাতাল ও আবাসিক এলাকা আছে, সেসব অঞ্চলের উপর দিয়ে এ ধরনের বিমান চালানো ঝুঁকিপূর্ণ।
তদন্ত চলছে, দায়ী কে?
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী জানিয়েছে, এই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাইলটের সঠিক পদক্ষেপ, বিমানের কারিগরি অবস্থা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সবকিছু বিশ্লেষণ করে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করা হচ্ছে না। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিহতদের পরিবারকে সহায়তা এবং আহতদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
সারসংক্ষেপ
উত্তরার এই দুর্ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিলো, কতটা গুরুত্বপূর্ণ বিমান নিরাপত্তা এবং প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার সঠিক মূল্যায়ন। পাইলট তৌকির ইসলাম হয়তো বড় বিপর্যয় এড়াতে পেরেছেন, কিন্তু তবু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে — এই দুর্ঘটনা কি প্রতিরোধযোগ্য ছিল?
বিশ্লেষকদের মতে, আগাম সতর্কতা, উন্নত রুট নির্ধারণ এবং যন্ত্রপাতির নিয়মিত তদারকি থাকলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।
এম আর এম – ০৪৪৬, Signalbd.com



