বাংলাদেশ

পাখি খাদ্যের আড়ালে এলো ২৫ টন পপির বীজ

Advertisement

পাকিস্তান থেকে আমদানির ঘোষণা ছিল ‘বার্ড ফুড’, কিন্তু খুলে দেখা গেল নিষিদ্ধ পপি বীজ — চট্টগ্রাম বন্দরে কাস্টমসের জালে ধরা পড়েছে এই রহস্যজনক চালান।

চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তান থেকে পাখির খাদ্যের আড়ালে আমদানি করা হয়েছে ২৫ টন পপি বীজ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে যা ‘ক’ শ্রেণির মাদক হিসেবে বিবেচিত। এই বিশাল পরিমাণ নিষিদ্ধ পণ্য জব্দ করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর আমদানি প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে কাস্টমস বিভাগ।

আমদানির ঘোষণায় ছিল পাখির খাদ্য, বাস্তবে পপি বীজ

চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর কোরবানিগঞ্জের প্রতিষ্ঠান মেসার্স আদিব ট্রেডিং পাকিস্তান থেকে দুই কনটেইনার পাখির খাদ্য আমদানির ঘোষণা দেয়। নথিতে ৩২ টন বার্ড ফুডের তথ্য থাকলেও, ৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার দুটি পৌঁছানোর পর কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়।

চালান দুটি বেসরকারি ডিপো ছাবের আহম্মেদ টিম্বার কোম্পানি লিমিটেডে নেওয়ার পর পরীক্ষার উদ্যোগ নেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। ২২ অক্টোবর কনটেইনার খোলার পর দেখা যায়, সামনের সারিতে কয়েকটি পাখির খাবারের বস্তা রাখা হলেও ভেতরের অংশে বস্তাভর্তি রয়েছে আমদানি-নিষিদ্ধ পপি বীজ।

কাস্টমসের তদন্তে ধরা পড়ে প্রতারণার কৌশল

গোপন তথ্যের ভিত্তিতে কাস্টমস কর্মকর্তারা চালানটির খালাস স্থগিত করে বিস্তারিত পরীক্ষা শুরু করেন। পরবর্তীতে নমুনা সংগ্রহ করে তিনটি পৃথক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। পরীক্ষার প্রতিবেদনে নিশ্চিত হয় যে, উদ্ধারকৃত পণ্য পপি বীজ এবং তা অঙ্কুরোদ্‌গম উপযোগী।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার এইচ এম কবির জানান, উদ্ধারকৃত ২৫ টন পপি বীজের বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা। “আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি ঘোষণার মাধ্যমে পণ্য গোপনের চেষ্টা করেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” বলেন তিনি।

আমদানি নিষিদ্ধ পপি বীজ কীভাবে মাদক হিসেবে গণ্য হয়

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পপি বীজ বা আফিম বীজ যদি অঙ্কুরোদ্‌গম উপযোগী থাকে, তবে তা থেকে আফিম উৎপাদন সম্ভব। এই কারণে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ অনুসারে পপি বীজ ‘ক’ শ্রেণির মাদক হিসেবে গণ্য হয়।

এ ছাড়া, দেশের আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ীও এই বীজ সরাসরি আমদানি নিষিদ্ধ। সাধারণত পপি বীজের নাম ব্যবহার করে পূর্বে একাধিকবার মাদক চোরাচালানের চেষ্টা ধরা পড়েছে বলে কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান।

পূর্বে এ ধরনের ঘটনার নজির

কাস্টমস ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে পাখির খাদ্য, পশুখাদ্য কিংবা মশলার চালানের আড়ালে একাধিকবার নিষিদ্ধ বীজ ও গাছের বীজ আনার চেষ্টা ধরা পড়েছে।

তবে এবারকার ঘটনাটি পরিমাণের দিক থেকে সবচেয়ে বড়। কারণ ২৫ টন পপি বীজ একসঙ্গে আমদানির ঘটনা চট্টগ্রাম বন্দরে আগে ঘটেনি। কর্তৃপক্ষ মনে করছে, এর পেছনে একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত থাকতে পারে যারা আন্তর্জাতিকভাবে মাদক বীজ পাচারে যুক্ত।

কাস্টমসের পরবর্তী পদক্ষেপ

কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আটককৃত পণ্য বাজেয়াপ্তের পাশাপাশি মেসার্স আদিব ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে মামলা প্রস্তুত করা হচ্ছে। পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত এজেন্ট ও পরিবহন সংস্থার ভূমিকা তদন্ত করা হবে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। যদি প্রমাণ পাওয়া যায় যে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃতভাবে মাদক বীজ আনার চেষ্টা করেছে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

বিশেষজ্ঞ মতামত ও বিশ্লেষণ

বাংলাদেশ কাস্টমস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “এই ঘটনা আমাদের আমদানি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব ও পর্যাপ্ত স্ক্যানিং ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়। নিয়মিত নজরদারি বাড়াতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের পণ্য প্রতারণা ঘটতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, “পপি বীজের মতো নিষিদ্ধ পণ্য সাধারণ পণ্যের আড়ালে আনা হচ্ছে, এটি আন্তর্জাতিক পাচারচক্রের একটি চিহ্ন। এখনই শক্ত হাতে ব্যবস্থা না নিলে এটি দেশের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে।”

ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট ও আইনগত পরিণতি

চট্টগ্রাম কাস্টমস জানিয়েছে, জব্দ করা পপি বীজ ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ব্ল্যাকলিস্ট করার বিষয়ে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা চলছে।

এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতোমধ্যে তদন্তে নেমেছে। বিশেষ শুল্ক গোয়েন্দা দল এই আমদানির সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমও খতিয়ে দেখছে।

দেশের অর্থনীতি ও মাদক নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও ডিজিটাল যাচাইকরণ প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী করা এখন সময়ের দাবি।

পাখির খাদ্যের আড়ালে ২৫ টন পপি বীজ আমদানির এই ঘটনা দেশের কাস্টমস নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নতুন প্রশ্ন তুলেছে। কর্তৃপক্ষের দাবি, আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে বড় প্রশ্ন থেকে যায় — আমদানি ও খালাস প্রক্রিয়ায় এত বড় পরিমাণ নিষিদ্ধ পণ্য কিভাবে ঢুকে গেল, এবং এ ধরনের চক্রগুলোকে থামানো কতটা সম্ভব হবে?

এম আর এম – ২১১৫,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button