জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া জোরালো ভাষণে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন— তেহরান কখনোই পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে না। একইসঙ্গে তিনি ইউরোপীয় দেশগুলোর দ্বিচারিতা, ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক নীতি এবং মার্কিন প্রভাবকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন। তার এই বক্তব্য এমন এক সময় এলো, যখন ইরান ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে।
ইরানের অবস্থান: শান্তির জন্য প্রতিশ্রুতি
প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,
“আমরা কোনোদিন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করব না। আমাদের লক্ষ্য হলো শান্তি, উন্নয়ন ও সার্বভৌম নিরাপত্তা।”
তার বক্তব্য ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি-র ঘোষণারই পুনরাবৃত্তি, যিনি একদিন আগে বলেছিলেন— ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে চায় না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
পশ্চিমা বিশ্বের চাপ ও পরমাণু চুক্তির পটভূমি
২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি
২০১৫ সালে ইরান এবং বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন (JCPOA) বা পরমাণু চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী, ইরান তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত রাখবে এবং বিনিময়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হবে।
কিন্তু ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে এই চুক্তি থেকে সরে আসেন এবং ইরানের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করেন। এর ফলে ইরান ধীরে ধীরে চুক্তির শর্ত মানা থেকে সরে আসে।
নতুন করে পশ্চিমাদের চাপ
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি (যাদের বলা হয় E3 বা ই-থ্রি) ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে তেহরান চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে। তারা সতর্ক করেছে—
- ইরান যদি আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের প্রবেশাধিকার পুনঃস্থাপন না করে,
- সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদের বিষয়ে স্বচ্ছতা না দেখায়,
- এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় না আসে,
তাহলে নতুন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হবে। এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে ইরানের বিদেশি সম্পদ জব্দ, অস্ত্র চুক্তি স্থগিত এবং ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি সীমিত হয়ে যাবে।
ইউরোপীয় ভণ্ডামির অভিযোগ
জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন—
- ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেদের নিরপেক্ষ ও ন্যায্য হিসেবে উপস্থাপন করে,
- কিন্তু বাস্তবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশেই কাজ করে,
- এবং ইরানের বৈধ পদক্ষেপগুলোকে চুক্তি ভঙ্গ বলে আখ্যায়িত করে।
তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন—
“তারা আসলে আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টাকে ছোট করে দেখিয়েছে। এই ভণ্ডামি বিশ্বকে বিভ্রান্ত করছে।”
ইসরায়েলের আগ্রাসন ও “গ্রেটার ইসরায়েল” পরিকল্পনা
সামরিক হামলার অভিযোগ
পেজেশকিয়ান তার ভাষণে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিমান হামলার কঠোর নিন্দা করেন। তিনি জানান, ইসরায়েলের আকস্মিক আক্রমণে এক হাজারের বেশি ইরানি নিহত হয়েছেন এবং দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়েছে।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, ইসরায়েল কেবল ইরান নয়, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং কাতারের ওপরও আক্রমণ চালাচ্ছে। এটি সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান।
“গ্রেটার ইসরায়েল” পরিকল্পনা
ইরানি প্রেসিডেন্ট বলেন, ইসরায়েল প্রকাশ্যে “গ্রেটার ইসরায়েল” পরিকল্পনার কথা বলছে। এর মূল লক্ষ্য হলো—
- ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল,
- প্রতিবেশী দেশগুলোতে ‘বাফার জোন’ তৈরি,
- এবং সামরিক শক্তির জোরে আধিপত্য বিস্তার।
তিনি বলেন—
“দুই বছর ধরে গণহত্যা, গণ-অনাহার, বর্ণবৈষম্য ও আগ্রাসনের পরও ইসরায়েল এই অবাস্তব ও বিপজ্জনক পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছে।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
ইরান সবসময় অভিযোগ করে এসেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারিতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
- একদিকে তারা শান্তির কথা বলে,
- অন্যদিকে ইসরায়েলকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা বাড়াচ্ছে।
পেজেশকিয়ান বলেন, আমেরিকার একতরফা সিদ্ধান্তই ইরানকে চুক্তির শর্ত পূরণে নিরুৎসাহিত করেছে।
ইরানের জনগণের প্রতিরোধ
প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান জাতিসংঘের মঞ্চে ইরানি জনগণের সাহস ও দেশপ্রেমের প্রশংসা করে বলেন—
“আমাদের জনগণ কখনোই আগ্রাসনের সামনে মাথা নত করবে না। আমরা শান্তি চাই, কিন্তু আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রয়োজন হলে আমরা লড়ব।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ অধিবেশনে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে বৈঠকের পর বলেন—
- এখনো চুক্তি সম্ভব,
- মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি,
- ইরানকে যৌক্তিক উদ্বেগের জবাব দিতে হবে।
এছাড়া অধিবেশনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই ও সিরিয়ার অন্তর্বর্তী নেতা আহমেদ আল-শারআ বক্তব্য রাখলেও মূল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ ও ইরান সংকট।
ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
বিশ্লেষকরা মনে করছেন—
- নতুন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে ইরানের অর্থনীতি ভয়াবহ চাপে পড়বে।
- তবে ইরান যদি কিছুটা ছাড় দেয়, তাহলে আলোচনার দ্বার খুলতে পারে।
- মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি নির্ভর করছে এই আলোচনার ভবিষ্যতের ওপর।
জাতিসংঘ অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানের বক্তব্য শুধু ইরান নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কিত। তার বার্তা স্পষ্ট— ইরান শান্তি চায়, কিন্তু সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আপস করবে না।
এই পরিস্থিতি বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে। এখন দেখার বিষয়— ইরান ও পশ্চিমা বিশ্বের টানাপোড়েন শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছায়, নাকি আরও বড় সংঘাতের দিকে ধাবিত হয়।
MAH – 13004 I Signalbd.com



