রাজনীতি

চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুর সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিএনপির বিক্ষোভ অব্যাহত

Advertisement

চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনে বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে দলে তীব্র ক্ষোভ ও বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এমএ হান্নান চৌধুরীর সমর্থকেরা বুধবার সকাল থেকে চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের ফরিদগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।
তারা সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে এবং টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। এতে পুরো এলাকা জুড়ে সৃষ্টি হয় উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি, থমথমে হয়ে ওঠে ফরিদগঞ্জ বাজার ও আশপাশের এলাকা।

মনোনয়ন বঞ্চনায় ক্ষুব্ধ হান্নান সমর্থকরা

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুর-৪ আসনে বিএনপির দীর্ঘদিনের সক্রিয় ও ত্যাগী নেতা এমএ হান্নান চৌধুরী এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি। কেন্দ্রীয় কমিটি তার পরিবর্তে সাবেক এমপি লায়ন হারুনুর রশিদকে মনোনয়ন দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

বুধবার সকাল ৮টার পর থেকেই ফরিদগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শত শত হান্নান সমর্থক জড়ো হয়ে সড়ক অবরোধ করেন। তারা টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে ‘অবিচারের প্রতিবাদে’ স্লোগান দিতে থাকেন। দুপুর নাগাদ পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের উত্তেজনা

সড়ক অবরোধের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিক্ষোভকারীদের সড়ক থেকে সরিয়ে নিতে গেলে সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিক্ষোভকারীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের চেষ্টা করেন। পরে পুলিশ ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

ফরিদগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন,

“এমএ হান্নান চৌধুরী সমর্থিত কিছু নেতা-কর্মী সকালে হঠাৎ করে মহাসড়ক অবরোধ করে। এতে প্রায় চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের বুঝিয়ে রাস্তা খালি করার চেষ্টা করছি। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে, তবে পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।”

ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ: ‘যেকোনো সময় সংঘর্ষ হতে পারে’

স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পরিবহন চালকরা জানান, সকাল থেকে সড়ক বন্ধ থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসসহ স্থানীয় যানবাহনগুলো রাস্তার দুই প্রান্তে আটকে পড়ে।
ফরিদগঞ্জ বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন,

“সকাল থেকে দোকান খোলার পর থেকেই দেখি চারপাশে আগুন আর ধোঁয়া। অনেকেই দোকান বন্ধ করে চলে গেছেন। মানুষ ভয়ে আছে, মনে হচ্ছে যেকোনো সময় বড় সংঘর্ষ হতে পারে।”

দুই গ্রুপে বিভক্ত ফরিদগঞ্জ বিএনপি

বিএনপির স্থানীয় রাজনীতিতে ফরিদগঞ্জে এখন স্পষ্ট বিভাজন দেখা যাচ্ছে। একদিকে এমএ হান্নান চৌধুরীর অনুসারীরা, অন্যদিকে মনোনয়ন পাওয়া সাবেক এমপি লায়ন হারুনুর রশিদের সমর্থকরা।
হারুনুর রশিদের সমর্থকরা আল মদিনা হাসপাতাল এলাকায় অবস্থান নেন এবং সেখানে থেকে পাল্টা সমাবেশের প্রস্তুতি নেন। দুপুরের দিকে ওই এলাকায় কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

লায়ন হারুনুর রশিদের ঘনিষ্ঠ নেতা নাছির পাটোয়ারী বলেন,

“আমাদের নেতা বিএনপির দুঃসময়ের সৈনিক। কেন্দ্রীয় কমিটি যথাযথভাবে চিন্তা করেই তাকে মনোনয়ন দিয়েছে। এখন যারা দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন, তারা বিএনপির আদর্শের প্রতি অনুগত নন। এসব বিশৃঙ্খলা আসলে ফ্যাসিবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।”

হান্নান সমর্থকদের বক্তব্য: “ত্যাগের মর্যাদা দেওয়া হয়নি”

বিক্ষোভরত হান্নান সমর্থকদের দাবি, তাদের নেতা এমএ হান্নান বিএনপির জন্য জীবন ও সম্পদ উজাড় করে দিয়েছেন। একাধিকবার কারাবরণ করেছেন, মিথ্যা মামলার ঘানি টেনেছেন, কিন্তু এবার তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।

একজন বিক্ষোভকারী বলেন,

“যিনি এমপি না হয়েও মানুষের পাশে থেকেছেন, তার মতো ত্যাগী নেতাকে বাদ দিয়ে বাইরের কাউকে মনোনয়ন দেওয়া অন্যায়। আমরা এই সিদ্ধান্ত মেনে নেব না। প্রয়োজনে ফরিদগঞ্জে বড় আন্দোলন গড়ে তুলব।”

বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংকট আরও গভীর

চাঁদপুর জেলার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ফরিদগঞ্জের এই দ্বন্দ্ব কেবল স্থানীয় নয়—এটি কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মো. রুহুল আমিন বলেন,

“বিএনপির জন্য ফরিদগঞ্জ ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ আসন। এখানে নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্য না থাকলে নির্বাচনে বড় ক্ষতি হতে পারে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উচিত দ্রুত মধ্যস্থতা করে সংকট সমাধান করা।”

থমথমে ফরিদগঞ্জ, যানবাহন চলাচল ব্যাহত

বুধবার দুপুর পর্যন্ত চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের ফরিদগঞ্জ অংশে যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। বিকেলে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আংশিকভাবে যানবাহন চলাচল শুরু হয়।
তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরো এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করে। অনেক দোকানপাট আগেভাগে বন্ধ হয়ে যায়, স্কুলছাত্রছাত্রীদেরও বাড়ি পাঠানো হয়।

ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জানান,

“আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছে।”

হারুনুর রশিদের রাজনৈতিক পটভূমি

লায়ন হারুনুর রশিদ বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির রাজস্ব ও ব্যাংকিং বিষয়ক সম্পাদক। তিনি একাধিকবার চাঁদপুর-৪ আসনে দলের প্রার্থী ছিলেন এবং একবার সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
দলের দুর্দিনে তিনি বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম ধরে রেখেছিলেন বলে দলীয় সূত্রে জানা যায়। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তার গ্রহণযোগ্যতা এবং দলের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণেই এবারও তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বলে দলীয় নেতারা জানান।

এমএ হান্নানের রাজনৈতিক ভূমিকা ও ত্যাগ

অন্যদিকে, এমএ হান্নান চৌধুরী দীর্ঘদিন ফরিদগঞ্জ উপজেলা বিএনপির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় কর্মকাণ্ডে তার প্রভাব ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
তিনি বিএনপির দুঃসময়ে কারাবরণ করেছেন এবং একাধিকবার মিথ্যা মামলার আসামি হয়েছেন। দলের ভিত্তি মজবুত রাখতে তিনি সবসময় সক্রিয় ছিলেন বলে স্থানীয় নেতারা জানান।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন,

“হান্নান চৌধুরীর জনপ্রিয়তা স্থানীয়ভাবে প্রবল। তাকে উপেক্ষা করলে বিএনপি স্থানীয় পর্যায়ে বিভক্ত হতে পারে, যা নির্বাচনী প্রস্তুতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”

কেন্দ্রের নীরবতা ও তৃণমূলের ক্ষোভ

এমন সংকটের মধ্যেও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। এতে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বাড়ছে।
ফরিদগঞ্জ পৌর বিএনপির এক নেতা বলেন,

“আমরা কোনো দলবিরোধী কাজ করছি না। শুধু ন্যায্য দাবি জানাচ্ছি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আমাদের কথা না শুনলে আন্দোলন বিস্তার লাভ করবে।”

প্রশাসনের কড়া নজরদারি

এদিকে সড়ক অবরোধের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। যেকোনো ধরণের নাশকতা রোধে জেলার অন্যান্য থানাগুলোকেও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

চাঁদপুর জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন,

“আমরা কারও গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছি না। কিন্তু সড়ক অবরোধ করে জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

ফরিদগঞ্জের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত মানুষের ভোগান্তি না বাড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের বিরোধ মিটিয়ে ফেলা।
ফরিদগঞ্জ কলেজের এক শিক্ষক বলেন,

“রাজনীতিতে মতবিরোধ থাকতেই পারে, কিন্তু সড়ক অবরোধ বা আগুন দেওয়া কোনো সমাধান নয়। এতে জনগণের আস্থা হারায় দলগুলো।”

চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুর মহাসড়কে বুধবারের ঘটনাটি বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংকটের এক স্পষ্ট প্রতিফলন। মনোনয়ন ইস্যু কেন্দ্র করে দলের ভেতরে যে ক্ষোভ ও বিভাজন তৈরি হয়েছে, তা দ্রুত না মেটালে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এখন দেখার বিষয়—বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিভাবে এ সংকট নিরসন করে মাঠের রাজনীতিতে ঐক্য ফিরিয়ে আনতে পারে।

MAH – 13638 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button