
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী কোনো দল এই দেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে পারবে না। তাঁর মতে, জামায়াতে ইসলামী এখনো সেই পুরোনো ধ্যানধারণা আঁকড়ে আছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাস ও মানচিত্রের বিরোধী। তাই তাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে নাসীরুদ্দীন এ মন্তব্য করেন। ওই পোস্টে তিনি বলেন,
“জামায়াতের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাদের রাজনৈতিক দর্শন ও অতীত আচরণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মানচিত্র ও জাতীয় চেতনার পরিপন্থী। তারা যতবার ইতিহাসের মঞ্চে ফিরে আসতে চেয়েছে, ততবারই জনগণের অন্তর থেকে প্রতিধ্বনি উঠেছে—না।”
জামায়াতের রাজনীতি ও অতীত আচরণ নিয়ে প্রশ্ন
নাসীরুদ্দীন বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই জামায়াতে ইসলামী দেশের রাজনীতিতে বারবার ফিরে আসার চেষ্টা করেছে, কিন্তু জনগণ কখনোই তাদের গ্রহণ করেনি। তিনি মন্তব্য করেন,
“যে দল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির অংশ ছিল, তারা দেশের নেতৃত্ব দিতে পারে না। আমাদের শহীদদের আত্মত্যাগের মর্যাদা রক্ষায় এই জাতি সবসময় সতর্ক।”
তার মতে, জামায়াত অতীতে ধর্মের নামে বিভাজনের রাজনীতি করেছে এবং এখনো সেই প্রবণতা পুরোপুরি ত্যাগ করেনি। তিনি মনে করেন, “বাংলাদেশ এখন মানবতা, ন্যায়বিচার ও সহাবস্থানের পথে চলছে। সেখানে ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই।”
‘দেশকে আর অন্ধকারে ফেরানো যাবে না’
ফেসবুক পোস্টে নাসীরুদ্দীন আরও লিখেন, “দেশকে আর অন্ধকারে ফেরানো যাবে না। আমরা এমন এক বাংলাদেশে বিশ্বাস করি, যেখানে ন্যায়, মানবতা ও সংহতির চেতনা থাকবে। এখানে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার আছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু এই স্বাধীনতা কোনো ষড়যন্ত্রের ঢাল হতে পারে না।”
তিনি বলেন, “প্রশাসনে ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশ, বিভাজনের রাজনীতি বা ধর্মের নামে রাষ্ট্র দখলের চেষ্টা—এই মাটিতে আর সফল হবে না।”
জুলাই অভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে নতুন এক প্রজন্মের তরুণ নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে, যারা অতীতের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরোধী। নাসীরুদ্দীনের দল এনসিপিও সেই তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় এনসিপি ও জামায়াতের মধ্যে কিছু বিষয়ে অবস্থান কাছাকাছি ছিল বলে মন্তব্য আসে। তবে পরবর্তীতে ‘জুলাই সনদে’ জামায়াতের স্বাক্ষর করা এবং এনসিপির না করা—দুই দলের মধ্যে মতাদর্শগত ফারাক স্পষ্ট করে দেয়।
এর আগে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও জামায়াতের চলমান আন্দোলনকে ‘রাজনৈতিক প্রতারণা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। নাহিদ বলেন, “জামায়াত কখনোই সংস্কারের আলোচনায় যুক্ত হয়নি, তারা কোনো বাস্তব প্রস্তাব দেয়নি, গণতন্ত্রের প্রতিও তারা আন্তরিক নয়।”
এই প্রেক্ষাপটে দুদিনের ব্যবধানে দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীনের এই মন্তব্য এনসিপির অবস্থান আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে।
‘বাংলাদেশ বিভাজনের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে’
নাসীরুদ্দীন বলেন, “যে মাটিতে শহীদদের রক্ত মিশে আছে, যে আকাশে মুক্তিযুদ্ধ ও গণআন্দোলনের আহ্বান ধ্বনিত হয়েছিল, সেই বাংলাদেশে বিভাজনের রাজনীতি কখনোই স্থান পাবে না।”
তিনি আরও যোগ করেন, “বাংলাদেশের কওমী, সুন্নি, হিন্দু, তরুণ ও প্রগতিশীল সব শ্রেণির মানুষ আজ এক বন্ধনে যুক্ত। এই বন্ধন হচ্ছে শান্তি, সৌহার্দ্য ও মানবিকতার বন্ধন।”
তার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়, এনসিপি ধর্মীয় বা মতাদর্শিক বিভাজনের চেয়ে নাগরিক ঐক্য ও মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছে।
‘আমরা মানবতার রাজনীতি চাই’
নিজ দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নাসীরুদ্দীন বলেন, “আমাদের দায়িত্ব শুধু প্রতিরোধ নয়, সুরক্ষা। বাংলাদেশের মানচিত্র, ইসলাম ও আলেম-উলামাদের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। তবে আমরা ঘৃণার নয়, মানবতার রাজনীতি চাই। যারা বিভ্রান্ত পথে গেছে, তাদের জন্য আমরা দরজা খোলা রাখি—যেন তারা ফিরে আসে গণতন্ত্র, ন্যায় ও মুক্তচিন্তার বাংলাদেশে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এই দেশ কারও শত্রুতা নয়—এই দেশ সহাবস্থানের, পারস্পরিক শ্রদ্ধার, এবং এক নতুন ভবিষ্যতের আহ্বান।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এনসিপি এখন নিজস্ব অবস্থান সুস্পষ্ট করতে চাচ্ছে। একদিকে তারা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে, অন্যদিকে জামায়াতের মতো দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে নিজেদের গণতান্ত্রিক চেহারা তুলে ধরছে।
একজন রাজনীতি বিশ্লেষক বলেন, “নাসীরুদ্দীনের বক্তব্য কেবল জামায়াতকে ঘিরে নয়, এটি বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মানসিকতার প্রতিফলন। তারা চায়, রাজনীতি হোক মূল্যবোধভিত্তিক, অন্ধ অনুসারিতার নয়।”
ন্যায় ও সংহতির পথে বাংলাদেশ
নাসীরুদ্দীনের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ এখন এমন এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে যেখানে ধর্মীয় রাজনীতি নয়, বরং নাগরিক চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধই মুখ্য হয়ে উঠছে।
তিনি যে বার্তা দিয়েছেন—“জামায়াতের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্নই আসে না”—তা কেবল রাজনৈতিক বিবৃতি নয়, বরং স্বাধীনতার চেতনা রক্ষার আহ্বানও বটে।
তবে রাজনৈতিক মহল মনে করছে, আগামী নির্বাচনের আগে এ ধরনের স্পষ্ট অবস্থান দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিকনির্দেশনাতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
এম আর এম – ১৮৮০,Signalbd.com