কৃষি

মাচায় তরমুজ চাষ, বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসি

Advertisement

বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন যুক্ত হচ্ছে। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার এসব প্রয়োগ দেশের কৃষকদের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে। এরই ধারাবাহিকতায় ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার হলিধানি এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ‘মাচা পদ্ধতিতে তরমুজ চাষে’ মিলেছে চমকপ্রদ সাফল্য। এই নতুন চাষ পদ্ধতি এখন কৃষকদের মাঝে আশার আলো জ্বালাচ্ছে।

মাচা পদ্ধতি ও মালচিং প্রযুক্তির সংমিশ্রণ

হলিধানি গ্রামের কৃষক আব্দুর রহিম চলতি বছর প্রথমবারের মতো মালচিং পদ্ধতির সঙ্গে মাচা পদ্ধতি মিলিয়ে গ্রীষ্মকালীন জাতের তরমুজ চাষ শুরু করেন। প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় এই পদ্ধতিতে মাটিবাহিত রোগ কম, পানি সাশ্রয় হয়, আর ফলনও হয় বেশি।
তিনি জানান, ৫২ শতাংশ জমিতে ১১টি মাচা বা ঝুলন্ত কাঠামো তৈরি করে তরমুজ চাষ করেছেন। প্রতিটি মাচায় ফল ঝুলে থাকায় তা সহজে পচে না বা রোগে আক্রান্ত হয় না। এতে ফলের গুণগত মানও বেড়েছে অনেকগুণ।

আব্দুর রহিম বলেন, “আগে তরমুজ চাষ নিয়ে আমার তেমন ধারণা ছিল না। কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে মালচিং পদ্ধতিতে চাষ শুরু করি। রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার না করে ভার্মি কম্পোস্ট দিয়েছি। দুই মাসের মধ্যে গাছে ফল ধরেছে, আর এখন প্রতিটি তরমুজ তিন থেকে পাঁচ কেজি ওজনের।”

খরচ কম, লাভ বেশি

এই পদ্ধতিতে চাষ করতে গিয়ে আব্দুর রহিমের মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু ক্ষেতের ফল বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ, দুই মাসের মধ্যেই তিনি লাভ করেছেন প্রায় ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, “তরমুজ এখনো পুরোপুরি বিক্রি শেষ হয়নি। বাজারে চাহিদা ভালো থাকায় দামও বেশ পাওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে তরমুজ চাষের পরিকল্পনা করেছি।”

তরমুজের মাচা পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে

মাচা পদ্ধতি মূলত ঝুলন্ত কাঠামো বা ফ্রেমে ফসল ফলানোর একটি প্রক্রিয়া। এতে গাছ মাটির সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শে থাকে না। ফলে রোগজীবাণুর আক্রমণ অনেক কমে যায় এবং ফল পচে না।
মাচায় তরমুজ চাষে প্রয়োজন হয় মজবুত বাঁশ, তার, দড়ি ও নেটের সাহায্যে তৈরি কাঠামো। গাছের লতা এই কাঠামোয় উঠিয়ে দেওয়া হয়, এবং ফল বড় হলে নেট ব্যাগে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এতে তরমুজ বাতাস ও সূর্যালোক পায়, ফলে তা দ্রুত বড় হয় ও মিষ্টি হয়।

মালচিং পদ্ধতির সুবিধা

মাচা পদ্ধতির পাশাপাশি মালচিং পদ্ধতি ব্যবহারে আরও সুবিধা মিলছে। এতে মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখা যায়, আগাছা কম জন্মে এবং ফলের নিচে মাটি স্পর্শ না করায় তরমুজের বাহ্যিক দাগ পড়ে না।
কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, মালচিং পদ্ধতিতে পানি সাশ্রয় হয় প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত, এবং সার প্রয়োগের কার্যকারিতা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। ফলে এই পদ্ধতিতে খরচ কমে আসে ২০-২৫ শতাংশ।

সরকারি কর্মকর্তাদের পরিদর্শন ও প্রশংসা

ঝিনাইদহের এই সফল তরমুজ ক্ষেত পরিদর্শন করেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল।
পরিদর্শনে ছিলেন—

  • কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম প্রধান ফেরদৌসী আখতার,
  • উপ প্রধান রত্না শারমীন ঝরা,
  • সিনিয়র সহকারী প্রধান প্রিয়াংকা দেবী পাল

তারা বলেন, “এই আধুনিক চাষপদ্ধতি শুধু কৃষকের আর্থিক অবস্থাই উন্নত করবে না, বরং এটি বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায়ও বড় ভূমিকা রাখবে।”
কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন “কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা জোরদারকরণ” প্রকল্পের অংশ হিসেবে এ ধরনের উদ্ভাবনী উদ্যোগকে ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত করা হবে বলেও জানান কর্মকর্তারা।

কৃষি কর্মকর্তাদের মতামত

ঝিনাইদহ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ নূর এ নবী বলেন, “গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষে এভাবে মাচা ও মালচিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা এক বড় উদ্ভাবন। এতে কৃষক যেমন লাভবান হবেন, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এখন অনেক কৃষক এই পদ্ধতি শিখতে আসছেন।”

তিনি আরও জানান, এ বছর জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২৫ একর জমিতে এই পদ্ধতিতে তরমুজ চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী মৌসুমে এটি দ্বিগুণ হবে বলে আশা করছেন তিনি।

কৃষকদের আগ্রহ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

স্থানীয় কৃষকরা এখন এই ক্ষেত দেখতে ভিড় করছেন। অনেকে আব্দুর রহিমের কাছ থেকে চাষ পদ্ধতি শিখে আগামী মৌসুমে নিজের জমিতে এই চাষ শুরু করতে চান।
কৃষকরা বলছেন, তরমুজ সাধারণত শীতকালে ভালো ফলন দেয়। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন জাতের তরমুজ যদি সফলভাবে উৎপাদন করা যায়, তবে সারা বছরই বাজারে এর চাহিদা বজায় থাকবে। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি রপ্তানির সম্ভাবনাও তৈরি হবে।

অর্থনৈতিক প্রভাব ও বাজার বিশ্লেষণ

বর্তমানে দেশের বাজারে গ্রীষ্মকালীন তরমুজের কেজি প্রতি দাম ৬০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে। তরমুজের স্বাদ মিষ্টি ও রসালো হওয়ায় এটি শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতেও চাহিদা পাচ্ছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের (ডিএএম) তথ্যমতে, তরমুজ চাষে প্রতি একরে গড় উৎপাদন খরচ হয় ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা। সঠিক ব্যবস্থাপনায় এই খরচের বিপরীতে লাভ হতে পারে দেড় লাখ টাকার বেশি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মাচা পদ্ধতি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা গেলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আবহাওয়ায় এটি অত্যন্ত উপযোগী একটি ফসল হতে পারে। এতে কৃষকের আয় বাড়বে, গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হবে এবং আমদানি নির্ভরতা কমবে।

পরিবেশবান্ধব কৃষির দৃষ্টান্ত

এই তরমুজ চাষে কোনো রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার না করায় এটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের জৈব চাষ পদ্ধতি মাটির উর্বরতা রক্ষা করে এবং জমির আয়ুষ্কাল বাড়ায়।
ফলে ভবিষ্যতে এই মডেলটি টেকসই কৃষি ব্যবস্থার একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে।

ঝিনাইদহের হলিধানি গ্রামের কৃষক আব্দুর রহিমের সাফল্যের গল্প এখন জেলার অন্য কৃষকদের প্রেরণার উৎস। মাচা পদ্ধতিতে তরমুজ চাষের এই নতুন অধ্যায় প্রমাণ করছে—সঠিক দিকনির্দেশনা, আধুনিক প্রযুক্তি এবং পরিশ্রম থাকলে কৃষিও হতে পারে সমৃদ্ধির পথ।

বাংলাদেশের কৃষিতে এই সাফল্য শুধু একটি ক্ষেতের গল্প নয়; এটি টেকসই কৃষি, প্রযুক্তিনির্ভর চাষাবাদ ও গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্জাগরণের প্রতীক।

MAH – 13682 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement
Back to top button