বাংলাদেশ

চীনের সহায়তায় বাংলাদেশে উন্নত হাসপাতাল নির্মাণ

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বড় ধরনের বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। ঢাকায় নিযুক্ত চীনা দূতাবাস এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ আলোচনা অনুযায়ী, দেশে নির্মাণ করা হতে পারে ‘চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ জেনারেল হাসপাতাল’ নামে একটি বৃহৎ ও আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। হাসপাতালটি হতে পারে ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা উত্তরবঙ্গের কোনো জেলায়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে চীনের সরকারি বিনিয়োগের একটি নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে।

চীনের সরকার এই হাসপাতালটিকে বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তির স্মারক হিসেবে একপ্রকার ‘উপহার’ আকারে দেবে বলে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি, হাসপাতাল ছাড়াও রোবোটিক ফিজিওথেরাপি, পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং অন্যান্য আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তির খাতে চীনা সহযোগিতা আসবে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো জানিয়েছে।

হাসপাতালটির সম্ভাব্য অবস্থান ও কাঠামো

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ জেনারেল হাসপাতাল’ নামে প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানটি হবে এক হাজার শয্যার আধুনিক চিকিৎসা কেন্দ্র। হাসপাতালের জন্য জমি নির্বাচন প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। সম্ভাব্য স্থান হিসেবে ঢাকার মিরপুর, উত্তরা ও ধামরাই এবং উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, রংপুর ও নীলফামারীকে বিবেচনা করা হচ্ছে।

নীলফামারী জেলায় ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি প্রতিনিধিদল জমি পরিদর্শনে গিয়েছিল। তারা জানিয়েছেন, ৫০০–৭০০ শয্যার হাসপাতালের জন্য কমপক্ষে ১২ একর ঝামেলামুক্ত জমি প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উত্তরবঙ্গ একটি চিকিৎসা হাবে রূপ নেবে।

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম জানান, “রংপুর অঞ্চলে হাসপাতালটি নির্মাণের সম্ভাবনাই বেশি। চীনা সরকার এটিকে বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ উপহার হিসেবে বিবেচনা করছে।”

তিনটি নতুন প্রকল্প: হাসপাতাল, পুনর্বাসন কেন্দ্র ও রোবোটিক ফিজিওথেরাপি

২০২৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এক সভায় চীনা সহযোগিতায় স্বাস্থ্যখাতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়। প্রকল্পগুলো হলো:

  1. একটি সাধারণ (জেনারেল) হাসপাতাল নির্মাণ।
  2. একটি টারসিয়ারি (তৃতীয় ধাপের) বিশেষায়িত হাসপাতাল।
  3. জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের জন্য একটি পুনর্বাসন সেন্টার।

এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে রোবোটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টারের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ইতোমধ্যেই দেশে এসে পৌঁছেছে। পুনর্বাসন সেন্টারটি বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

চীনের বিনিয়োগ: স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘমেয়াদি সম্পৃক্ততা

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। বহু বছর ধরেই বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প চীন থেকে অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (API) বা ওষুধের কাঁচামাল আমদানি করে আসছে। মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের একটি বড় অংশও আসে চীন থেকেই। এছাড়া, বহু বাংলাদেশি শিক্ষার্থী প্রতি বছর চীনের বিভিন্ন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়।

বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির সময় বাংলাদেশ চীন থেকে ব্যাপক পরিমাণে টিকা আমদানি করেছিল। এর পাশাপাশি ভ্যাকসিন উৎপাদনে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছিল চীন। এবার সেই সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হতে যাচ্ছে পরিকাঠামো ও স্বাস্থ্যসেবার সরাসরি উন্নয়নের মাধ্যমে।

ঢাকায় হাসপাতাল ছাড়া আরও প্রকল্প: ঢামেকের আধুনিকায়নেও সহায়তা

চীনের অর্থায়নে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আধুনিকায়ন ও সংস্কার প্রকল্পের কাজও অচিরেই শুরু হতে পারে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রস্তাবনা তৈরি হয়ে গেছে এবং দ্রুত অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের পক্ষ থেকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের বিনিয়োগ শুধু স্বাস্থ্য খাতেই নয়, বাংলাদেশের চিকিৎসা শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রযুক্তি স্থানান্তরের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

চীনা প্রতিনিধিদলের আগমন: সিদ্ধান্ত হতে পারে চূড়ান্ত

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম জানিয়েছেন, খুব শিগগিরই চীন থেকে ২০০ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করবে। এই সফরের সময় হাসপাতালের চূড়ান্ত অবস্থান, নির্মাণ পরিকল্পনা এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।

তিনি বলেন, “এই সফরের মাধ্যমেই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হবে বলে আমরা আশাবাদী। স্বাস্থ্য খাতে এই নতুন অধ্যায় বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করবে।”

বড় বিনিয়োগের সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

চীনের এই উদ্যোগকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরে পর্যায়ক্রমে আধুনিক হাসপাতাল ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে নতুন মেডিকেল জোন ও স্বাস্থ্য প্রযুক্তি পার্ক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বে পরিচালিত এই ধরনের হাসপাতালগুলি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার সামগ্রিক মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সেইসঙ্গে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমিয়ে আনার দিকেও এটি বড় ধাক্কা দিতে পারে।

বাংলাদেশে চীনের বড় পরিসরের স্বাস্থ্য বিনিয়োগ কেবল কূটনৈতিক বন্ধুত্বের প্রতীক নয়, বরং এটি দেশের স্বাস্থ্যখাতের আধুনিকায়নের একটি বড় মাইলফলক। চিকিৎসা অবকাঠামোতে এমন উদ্যোগ সরাসরি দেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার বাড়াবে এবং স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন ঘটাবে। চীনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে ফলপ্রসূ হবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button