বাংলাদেশের নাটক ইন্ডাস্ট্রি বর্তমানে এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত। শুটিংয়ের কাজ ক্রমেই কমে যাচ্ছে, তাই প্রতিদিন নানান শিল্পী ও কলাকুশলীর ঘরে কাজ নেই। মশাররফ করিম, তানিয়া বৃষ্টি থেকে শুরু করে অনেক জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এখন শুটিংয়ের সুযোগ পাচ্ছেন না। এই সংকট শুধু ঈদের পরে নয়, বরং গত কয়েক মাস ধরে নাটক নির্মাণের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
নাটক শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি
একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিনেতা জানান, আগে প্রতি মাসে ১৫-২০ দিন শুটিং করতেন, একদিনে পারিশ্রমিক পেতেন ১০-১২ হাজার টাকা। কিন্তু এখন গত দুই মাসে মাত্র আটদিন কাজ করেছেন, ঈদের পর শুধু দুই দিন। পরবর্তী শুটিংয়ের তারিখও ধার্য করা হয়েছে মাসের শেষে। নির্মাতাদের সঙ্গে কথা বললেও একই সুর শোনা যায়—“কাজ নেই, কাজ নেই।”
টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের এক সূত্র জানায়, এই ঈদে গত চার বছরের তুলনায় নাটক প্রচারের সংখ্যা সবচেয়ে কম ছিল। শুধু ঈদেই নয়, এর পরবর্তী সময়েও নাটক নির্মাণের কাজ অব্যাহতভাবে কমেছে। যার কারণে শিল্পীরা দিন দিন বেকার হয়ে পড়ছেন।
শিল্পীদের হালচাল: শুটিং থেকে দূরে
অভিনয় শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ মামুন অপু বলেন, “ঈদের পর সাধারণত কাজ কম থাকে, কিন্তু গত চার-পাঁচ মাস ধরে যে মাত্রায় কাজ কমেছে তা নজিরবিহীন। অনেক শিল্পী করোনাকালীন সময়ের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করছেন।”
রাজধানীর উত্তরা এলাকার শুটিং বাড়ির সংখ্যা ১৫ থেকে এখন মাত্র অর্ধেকে নেমে এসেছে। ‘শুটিং হাউস অ্যাসোসিয়েশন’ সভাপতি আবদুল আলিম জানান, “অবস্থা এতটাই খারাপ যে অনেক শুটিং বাড়ি বন্ধ করতে হয়েছে। মাসে লাখ টাকা খরচ হয়, কিন্তু আয় নেই। এখন শুটিং হয় খুবই কম।”
এক প্রোডাকশন ম্যানেজার বলেন, “দেশে বর্তমানে মাত্র ৯টি শুটিং ইউনিট কাজ করছে, অধিকাংশ সরকারি তথ্যচিত্রের শুটিং। আর উত্তরা এলাকায় শুটিং এখন নেই বললেই চলে। অনেকেই গ্রামে চলে গেছেন, কেউ কেউ বিক্রি-দোকান চালাচ্ছেন।”
প্রিয় অভিনেতাদের অনুপস্থিতি
ঈদের পর জনপ্রিয় অভিনেতা যেমন জিয়াউল ফারুক অপূর্ব, নিলয় আলমগীর, তৌসিফ মাহবুব, ফারহান আহমেদ জোভান, মুশফিক সহ অনেকেই নিয়মিত কাজে দেখা যাচ্ছে না। কেউ ঈদের ছুটি নিচ্ছেন, কেউবা ভালো বাজেটের কাজের অপেক্ষায় রয়েছেন।
এক শীর্ষ অভিনেতা বলছেন, “আগের মতো মাসে ৫০-৬০টি প্রস্তাব আসতো, এখন ২০-২৫টি। কাজের সংখ্যা কমেছে, বাজেটও কমেছে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এখনও কাজ করছি।”
নাটকের জনপ্রিয় পরিচালক হাসিব হোসাইন বলেন, “আমি খুবই কম কাজ করি, মাসে বা দুই মাসে একটা নাটক করি, তবুও আগের মতোই। তবে অন্যান্যদের বিষয়ে বলতে পারব না।”
নাটক প্রযোজকদের দৃষ্টিভঙ্গি
নাট্য প্রযোজক সমিতির নেতা সাজু মুনতাসির জানান, “কিছু কাজ হচ্ছে, তবে বেশির ভাগ চ্যানেল এখন এক ঘণ্টার নাটক প্রচার করে না। অধিকাংশ নাটক এখন ইউটিউবে প্রকাশ পাচ্ছে। স্পনসরশিপ ও বিজ্ঞাপনের অভাবের কারণে প্রযোজকরা লোকসানে পড়ছেন। ইউটিউব থেকেও আয় কমে গিয়েছে, ব্র্যান্ডিং নেই।”
তিনি আরও বলেন, “দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর নাটক শিল্পের ভবিষ্যত নির্ভর করবে। এখন সবাই স্থিরতার অপেক্ষায়।”
সংকটের মূল কারণ ও পরিণতি
বাংলাদেশের নাটক ইন্ডাস্ট্রির এই অবনতি বহু কারণে ঘটছে। প্রথমত, অর্থনৈতিক মন্দা ও বিজ্ঞাপন সংকট প্রধান কারণ। চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপনের আয় কমে যাওয়ায় নাটকের বাজেটও কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, ইউটিউবসহ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নাটকের সংখ্যা বাড়লেও আয় কম হওয়ায় প্রযোজকরা নতুন নাটক নির্মাণে অনাগ্রহী। তৃতীয়ত, করোনাকালীন সময়ে তৈরি অনিশ্চয়তা আর বর্তমান বাজেট সংকট শিল্পীদের কাজ হারানোর অন্যতম কারণ।
এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে নাটক শিল্পে আরও অনেক প্রতিভাবান শিল্পী কাজ হারাতে পারেন, শুটিং বাড়ি বন্ধ হয়ে যেতে পারে, আর নাটক নির্মাণ একটি সংকটময় অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে না।
শিল্পীদের অনুরোধ ও সরকারের ভূমিকা
শিল্পীরা সরকারের কাছে দ্রুত সহায়তা ও নীতিগত সাহায্যের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন। করোনাকালীন সময়ে অনেক সাহায্য পেয়েছিলেন, কিন্তু বর্তমানে সাহায্যের প্রয়োজন আরও বেশি। শিল্পী ও প্রযোজকরা চাইছেন টেলিভিশন চ্যানেল ও প্রযোজক সংস্থাগুলো যেন কাজের সুযোগ বাড়ায় এবং শিল্পীদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশের নাটক শিল্প দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি বড় অংশ। শিল্পীরা আজ যে সংকটে পড়েছে, তা শুধু তাদের নয়, দর্শকদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সময় এসেছে একত্রে উদ্যোগ নিয়ে নাটক শিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণের। শিল্পীদের কাজ ফিরিয়ে আনা, প্রযোজকদের উৎসাহিত করা, বিজ্ঞাপন ও স্পনসরশিপ বৃদ্ধি এবং নতুন উদ্যোগ নেয়া গেলে নাটক শিল্প আবারও তার স্বর্ণযুগ ফিরে পেতে পারে।



