আরব নেতাদের বৈঠক শুক্রবার: ট্রাম্পের পরিকল্পনা মোকাবেলা ও গাজা পুনর্গঠন

রিয়াদ, সৌদি আরব — সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের আমন্ত্রণে শুক্রবার আরব নেতারা সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে এক বৈঠকে মিলিত হবেন। বৈঠকে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা উপত্যকা নিয়ে প্রস্তাবিত পরিকল্পনা এবং তার প্রভাব মোকাবেলায় আলোচনা হবে। ট্রাম্পের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আরব দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তৈরির লক্ষ্যে এই বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
সৌদি রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা এসপিএ-এর তথ্য মতে, বৈঠকে সৌদি আরব, মিসর, জর্দান এবং উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর শীর্ষ নেতা উপস্থিত থাকবেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বৈঠকটি আরববিশ্ব এবং ফিলিস্তিন ইস্যুর জন্য ঐতিহাসিক মুহূর্ত হতে পারে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনা ও আরব ঐক্যের গুরুত্ব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গাজা উপত্যকায় তার প্রস্তাবিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গাজা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসনিক পরিবর্তন এবং ২৪ লাখ গাজার বাসিন্দাকে মিসর ও জর্দানে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাবটি বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে আরব দেশগুলো একযোগভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়।
সৌদি আরবের কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ উমর করিম জানিয়েছেন, এই বৈঠকটি আরববিশ্বের জন্য ‘সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ’ হবে, এবং বৈঠকটি অনানুষ্ঠানিকভাবে অনুষ্ঠিত হবে। তবে, এতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে আলোচনায় বসবেন।
মিসরের পরিকল্পনা
এদিকে, মিসরের পক্ষ থেকে গাজার পুনর্গঠনের জন্য একটি তিনধাপের পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়েছে, যার প্রথম পর্যায়ে ধ্বংসস্তূপ সরানো এবং নিরাপদ অঞ্চল স্থাপন করা হবে। মিসরের সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ হেগাজি জানিয়েছেন, গাজার পুনর্গঠনের জন্য ৩-৫ বছরের মধ্যে তিনটি পর্যায়ে কাজ সম্পন্ন হবে।
প্রথম পর্যায়ে ছয় মাস ধরে প্রাথমিক পুনর্গঠন শুরু হবে, যেখানে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ধ্বংসস্তূপ সরানো হবে এবং নিরাপদ অঞ্চল গঠন করা হবে। এই অঞ্চলগুলোতে বাসিন্দাদের স্থানান্তর করা হতে পারে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে যেখানে পুনর্গঠন পরিকল্পনা এবং অবকাঠামো পুনরুদ্ধারের বিস্তারিত আলোচনা হবে।
চূড়ান্ত পর্যায়ে গাজার নগর পরিকল্পনা, আবাসন নির্মাণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা স্থাপন হবে। জাতিসংঘের মতে, গাজা পুনর্গঠনে ৫৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ হবে, যার মধ্যে প্রথম তিন বছরের জন্য ২০ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
গাজার পুনর্গঠনের জন্য মিসরের পরিকল্পনাকে সামনে রেখে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর অর্থায়ন। উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে কুয়েত মানবিক কারণে কিছু সহায়তা প্রদান করতে আগ্রহী হতে পারে, তবে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত কেবল তখনই অর্থ সহায়তা দেবে, যদি কাতার এবং মিসর হামাসের প্রতি নিশ্চয়তা প্রদান করে।
এছাড়া, মিসরের পরিকল্পনায় গাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নতুন প্রশাসন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকবে। তবে এই পরিকল্পনাতেও মতপার্থক্য রয়েছে। একদিকে, সৌদি আরব গাজার নিয়ন্ত্রণ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে দেখতে চায়, অন্যদিকে, কাতার ও অন্যান্য আরব দেশগুলো মনে করে, গাজার ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনিদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
হামাস ও গাজার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
এক্ষেত্রে, মিসরের পরিকল্পনার সফলতা নির্ভর করবে গাজায় কোনো রাজনৈতিক দল ছাড়া একটি নন-পলিটিক্যাল প্রশাসন গঠনের ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে হামাসের উপস্থিতি আরব বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, বিশেষত মার্কিন প্রশাসন ও ইসরায়েলের কাছে।
মিসরীয় সাবেক কূটনীতিক হেগাজি জানান, গাজার পুনর্গঠন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রভাব ছাড়া একটি প্রযুক্তিগত ও আইনগত সমাধান প্রয়োজন। এর মাধ্যমে গাজার যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে সুষ্ঠু তদারকি নিশ্চিত করা হবে।
আরব ঐক্যের প্রয়োজন
এদিকে, সৌদি আরবের কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ উমর করিম বলেছেন, গাজার পুনর্গঠন ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সফল আলোচনার জন্য প্রয়োজন ‘এক ধরনের আরব ঐক্য’, যা বহু দশক ধরে দেখা যায়নি। এই ঐক্য গড়ে তোলা না গেলে, গাজার সমস্যা সমাধান করা কঠিন হবে।
আরব দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য সত্ত্বেও, বৈঠকে গাজার পুনর্গঠনে সহযোগিতার বিষয়ে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের আশা করা হচ্ছে। তবে, এর অর্থায়ন এবং রাজনৈতিক সমাধান নিয়ে মতপার্থক্য রয়ে যাওয়ায় এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হতে পারে।
পরবর্তী পদক্ষেপ
এখন, মিসরের প্রস্তাবিত পরিকল্পনা এবং আরব নেতাদের বৈঠকে উঠা নানা বিষয়গুলোর ওপর নজর রাখা হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যেহেতু গাজার পুনর্গঠন এবং রাজনৈতিক সমাধান দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই এই বৈঠকটি আরব বিশ্বের জন্য নতুন এক রাজনৈতিক দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
এসপিএ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আগামী ৪ মার্চ মিসরে অনুষ্ঠিত একটি জরুরি আরব সম্মেলনে নেয়া হবে। সেখানে গাজা পুনর্গঠন এবং রাজনৈতিক সমাধানের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা উপস্থাপন করা হবে।