
বাংলাদেশে টাইফয়েড প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় জাতীয় কর্মসূচি শুরু হতে যাচ্ছে। এ উদ্যোগকে সফল করতে দেশের আলেম সমাজ, ইমাম এবং মাদ্রাসা শিক্ষকদের সক্রিয় ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
রবিবার রাজধানীর ইসলামিক ফাউন্ডেশন সভাকক্ষে আয়োজিত “টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন-২০২৫” উপলক্ষ্যে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক বিশেষ সভায় এ আহ্বান জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর।
কেন এই টিকাদান জরুরি?
বাংলাদেশে টাইফয়েড এখনো একটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি। প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়, বিশেষ করে শিশুরা। চিকিৎসকরা বলছেন—অপরিষ্কার পানি, দূষিত খাবার এবং স্যানিটেশনের অভাব টাইফয়েড ছড়ানোর প্রধান কারণ।
জাতীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয় এবং শিশুদের মধ্যে মৃত্যুহারও উপেক্ষা করার মতো নয়। ফলে প্রতিরোধক টিকাদান ছাড়া এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং ইউনিসেফ জানিয়েছে, টাইফয়েড প্রতিরোধে কার্যকর টিকা রয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে সুরক্ষা দেয়। বাংলাদেশে আসন্ন এ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে প্রায় ৫ কোটি শিশুকে বিনামূল্যে টাইফয়েডের টিকা দেওয়া হবে।
আলেম-ইমামদের ভূমিকায় নতুন দিগন্ত
কোভিড-১৯, হাম-রুবেলা এবং এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচিতে আলেম সমাজ ও ইমামদের ভূমিকা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। শুক্রবারের খুতবা, মাদ্রাসার ক্লাস কিংবা মসজিদের আলোচনা সভায় তারা সাধারণ মানুষকে টিকা সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছিলেন।
এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবার টাইফয়েড টিকা নিয়েও তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আশা করছে সরকার।
সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন—
“আলেম সমাজ, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, ইমাম ও মাদ্রাসা শিক্ষকরা দেশের টিকা কর্মসূচিতে ইতিমধ্যেই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। এবারও তাদের সহায়তায় আমরা টাইফয়েড টিকাদানকে সফল করতে চাই।”
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আহ্বান
সভায় সভাপতিত্ব করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আ. ছালাম খান। তিনি বলেন—
“টাইফয়েড প্রতিরোধে জনগণের মাঝে সচেতনতা তৈরি এবং টিকা গ্রহণে উৎসাহিত করতে ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের প্রতিটি স্তরে ইমাম, খতিব ও মাদ্রাসা শিক্ষকরা যদি সচেতনতা বাড়ান, তবে ক্যাম্পেইন আরও সফল হবে।”
তিনি আরও বলেন, ইসলাম ধর্মে মানুষের জীবন রক্ষা করা একটি বড় দায়িত্ব। টিকাদান জীবন রক্ষারই অংশ। তাই প্রতিটি মসজিদের ইমাম যেন খুতবায় এ বিষয়ে আলোকপাত করেন, তা অত্যন্ত প্রয়োজন।
শিশু ও পরিবারের দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা
বক্তারা বলেন, টাইফয়েড টিকা শুধু শিশুদের নয়, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও সুরক্ষা দেবে। কারণ শিশুদের মাধ্যমে প্রায়ই পরিবারের অন্যরা সংক্রমিত হয়। একবার টিকা নিলে দীর্ঘ কয়েক বছর টাইফয়েড প্রতিরোধ করা সম্ভব।
তাদের মতে, একটি শিশুকে অসুস্থ হওয়া থেকে বাঁচানো মানেই পুরো পরিবারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা
টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচির কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে ইউনিসেফ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। ইউনিসেফ বাংলাদেশ জানিয়েছে—
“আমরা চাই বাংলাদেশে প্রতিটি শিশু টাইফয়েড থেকে সুরক্ষিত থাকুক। এজন্য ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্বের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।”
সভায় ইউনিসেফ ও ডব্লিউএইচও’র প্রতিনিধিদের পাশাপাশি জাতীয় সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
কারা উপস্থিত ছিলেন?
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন—
- হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মুফতী মাছউদুল করীম
- খাদেমুল ইসলাম জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মো. নাজমুল হক
- মাদানী নেসাব শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি আরিফ হাক্কানী
- বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি মুহিবুল্লাহ বাকী আন নদভী
- ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও উপপরিচালকবৃন্দ
তারা সবাই একমত হন যে, জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মসজিদ, মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করা হবে।
টাইফয়েড টিকার বৈজ্ঞানিক দিক
টাইফয়েডের টিকা (Typhoid Conjugate Vaccine – TCV) শিশুদের জন্য নিরাপদ এবং কার্যকর। একবার টিকা নেওয়ার পর অন্তত ৫-৭ বছর পর্যন্ত সুরক্ষা পাওয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, এই টিকা গ্রহণে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি নেই।
বাংলাদেশে পূর্বে ছোট পরিসরে এ টিকা ব্যবহার করা হলেও এবার প্রথমবারের মতো জাতীয় পর্যায়ে এত বৃহৎ আকারে টিকাদান শুরু হচ্ছে।
আগের অভিজ্ঞতা: কোভিড-১৯ টিকাদান
কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিল। গ্রাম থেকে শহর, মসজিদ থেকে হাটবাজার—প্রতিটি স্থানে ইমাম ও স্থানীয় নেতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।
সেই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এবার টাইফয়েডের টিকাদানেও একই কৌশল ব্যবহার করা হবে।
সামনের চ্যালেঞ্জ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকাদানের পাশাপাশি পানি ও খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি। কারণ টাইফয়েড মূলত দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়।
এ কারণে টিকাদানের পাশাপাশি জনগণকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের পরামর্শও দেওয়া হবে।
বাংলাদেশে আসন্ন টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি শুধু একটি স্বাস্থ্য উদ্যোগ নয়, বরং শিশুদের ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য একটি জাতীয় প্রতিশ্রুতি। ধর্মীয় নেতাদের নেতৃত্ব, সরকারের উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সমন্বয়ে এ কর্মসূচি সফল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রতিটি শিশুকে টিকা দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে “সবার জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার” লক্ষ্য অর্জনে।
MAH – 12814 Signalbd.com