যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় অক্টোবর মাসে গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল। সেই ঘোষণা আশা জাগিয়ে ছিল, অন্তত শিশুদের রক্ষা করা যাবে, নিরীহ প্রাণে আর বোমা পড়বে না—এমনটাই বিশ্বাস করেছিল পুরো বিশ্ব। কিন্তু সেই আশার আলো বেশিদিন টেকেনি। জাতিসংঘের শিশু তহবিল—ইউনিসেফ জানাচ্ছে, যুদ্ধবিরতির পরও গাজায় একের পর এক হামলা হয়েছে, নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৬৭ জন ফিলিস্তিনি শিশু।
শুক্রবার জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে ইউনিসেফের মুখপাত্র রিকার্ডো পাইরেস জানান, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ইসরাইলি আগ্রাসন থামেনি। বরং অনেক জায়গায় হামলার ধরন আরও অপ্রত্যাশিত হয়েছে। পাইরেস বলেন, এসব শিশুর মৃত্যু শুধু সংখ্যা নয়—এগুলো বহু পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার প্রতিচ্ছবি।
খান ইউনিসে বাড়িতে বোমা, প্রাণ গেল শিশু কন্যার
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শহরে একদিন আগেও ইসরাইলি বিমান হামলা হয়েছে। একটি ঘুমন্ত পরিবারের বাড়িতে বোমা পড়ে মুহূর্তেই ধসে যায় পুরো বাড়ি—সেখানে মারা যায় এক শিশু কন্যা। এ ঘটনায় নিহত আরও কয়েকজনের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
এই শিশুটির নাম ইউনিসেফ উল্লেখ না করলেও মুখপাত্র পাইরেস জানান, শিশুটি ছিল পরিবারের একমাত্র কন্যা, তার বাবা-মা হামলার পর মিনিটখানেকের মধ্যেই ধ্বংসস্তূপ থেকে নিস্তেজ দেহ বের করে আনেন। ঘটনাটি আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র নিন্দার জন্ম দিয়েছে।
এমন আরও সাত শিশু নিহত হয় আগের দিন
ইউনিসেফ জানায়, এর আগের দিন পৃথক হামলায় নিহত হয়েছে আরও সাত শিশু। যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকা সত্ত্বেও এসব হামলা কয়েক ঘণ্টা পরপর ঘটছে, বিশেষ করে দক্ষিণ গাজায়।
পাইরেস সংবাদ সম্মেলনে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, “এরা সবাই যুদ্ধবিরতির পর নিহত হয়েছে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং শিশুদের প্রতি এক ধরনের অব্যাহত নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্ত।”
শুধু সংখ্যা নয়, হারিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ
ইউনিসেফ বহুবার জানিয়েছে—এগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়; প্রতিটি নিহত শিশুর ছিল একটি পরিবার, একটি স্বপ্ন, একটি ভবিষ্যৎ। যুদ্ধবিরতির পরও এই মৃত্যুর মিছিল থামেনি।
গাজায় চলমান সংকটকে শিশু অধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে ভয়ংকর উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। তাদের মতে, গাজার এক প্রজন্ম কার্যত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
৬৪ হাজার শিশু হতাহত: ইউনিসেফের বড় উদ্বেগ
ইউনিসেফের গত মাসের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এই পর্যন্ত—গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর ইসরাইলি আক্রমণে ৬৪ হাজার ফিলিস্তিনি শিশু হতাহত হয়েছে। এ সংখ্যা পৃথিবীর যেকোনো সংঘাত অঞ্চলের তুলনায় বহুগুণ বেশি।
এতে উল্লেখ ছিল—গাজায় শিশুরা দুই ধরনের হুমকিতে আছে:
১) সরাসরি বিমান ও স্থল হামলা,
২) মানবিক বিপর্যয়—ক্ষুধা, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা সেবার অভাব।
সেভ দ্য চিলড্রেন: প্রতি মাসে গড় ৪৭৫ শিশু পঙ্গু
শিশু অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন জানায়, ২০২৪ সালে যুদ্ধের কারণে প্রতি মাসে গড়ে ৪৭৫ জন ফিলিস্তিনি শিশু স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়েছে।
এই পঙ্গুত্বের মধ্যে রয়েছে—
- মস্তিষ্কে আঘাত
- দেহ পুড়ে যাওয়া
- অঙ্গহানি
- মানসিক আঘাতে স্থায়ী প্রতিবন্ধকতা
সংস্থাটি জানিয়েছে, চিকিৎসার অভাবে অনেক আঘাতই সময়মতো সামাল দেওয়া যায় না। গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ায় শিশুদের অধিকাংশই শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যাচ্ছে।
যুদ্ধবিরতিতে কী আছে—কেন থামছে না হামলা?
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতিতে ছিল অস্ত্রবিরতি, মানবিক করিডর খোলা এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ সংস্থার মাধ্যমে নজরদারি—কিন্তু বাস্তবে এসব শর্ত পূরণ হয়নি।
মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞদের মতে—
- মানবিক করিডর খোলার কথা থাকলেও অনেক জায়গায় অবরোধ রয়েছে
- সীমান্ত দিয়ে খাদ্য, পানি বা ওষুধ ঢুকতে পারছে না
- যুদ্ধবিরতির অর্থই ছিল সীমিত পর্যায়ের সামরিক কার্যক্রম বন্ধ—কিন্তু বোমাবর্ষণ পুরোপুরি থামেনি
ফলে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ইসরাইলের অবস্থান
ইসরাইল দাবি করছে—তারা শুধু টার্গেটেড অপারেশন চালাচ্ছে এবং হামাস বাহিনীকে লক্ষ্য করে হামলা করা হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, বাস্তব পরিস্থিতি এর সম্পূর্ণ বিপরীত; অনেক ক্ষেত্রে বেসামরিক আবাসিক এলাকায় নির্বিচারে বোমা ফেলছে ইসরাইল।
জাতিসংঘ বলেছে—গাজায় নিহত বেসামরিক মানুষের মধ্যে শিশু > নারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর বেদনা—‘আমাদের শিশুদের রক্ষা করতে পারেনি কেউ’
বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, গাজায় এখন বাবারা সন্তানদের কবর দিতে দিতে ক্লান্ত। শিশুদের যেভাবে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে, অনেক সময় তাদের নাম-পরিচয়ও শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
খান ইউনিসের বাসিন্দা একজন বাবা বলেছেন—
“আমরা যুদ্ধবিরতির অপেক্ষায় ছিলাম। ভেবেছিলাম অন্তত বাচ্চারা বাঁচবে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি আমাদের জন্য কোনো নিরাপত্তা আনতে পারেনি।”
গাজার মনোবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন—যেসব বাচ্চারা বেঁচে আছে তারাও ভয়াবহ মানসিক আঘাত নিয়ে বড় হচ্ছে।
একটি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—গাজার ৯০ শতাংশ শিশু রাতে ঘুমাতে পারে না।
এদের অধিকাংশের মধ্যে দেখা যাচ্ছে—
- ভয়
- ট্রমা
- আতঙ্ক
- শব্দে চমকে ওঠা
- কথা না বলা
এগুলো দীর্ঘমেয়াদে এক বড় মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হবে।
আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
ইউনাইটেড নেশনস হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব লীগসহ বহু আন্তর্জাতিক সংগঠন গাজার পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে—
- যুদ্ধবিরতি কার্যকর নয়
- মানবিক সহায়তা ঢুকতে পারছে না
- আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন ঘটছে
এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলমান বিক্ষোভে গাজার শিশুদের রক্ষার দাবি অব্যাহত রয়েছে।
বিশ্লেষণ: গাজার শিশুদের ভবিষ্যৎ কি তবে অন্ধকার?
গাজা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘শিশু সংকট অঞ্চল’।
বিশ্লেষকদের মতে—যদি দ্রুত সমাধান না আসে, তবে তাদের আগামী প্রজন্ম কার্যত হারিয়ে যেতে পারে।
যুদ্ধের মাঝেও শিশুরা যে তিন ধরনের সংকটে আছে—
১) নিরাপত্তাহীনতা:
যেকোনো সময় বোমা, ড্রোন বা গোলার আঘাতে মৃত্যু।
২) খাদ্য ও পানি সংকট:
পরিস্থিতি এমন যে অনেক শিশু দিনে একবেলাও খাবার পাচ্ছে না।
৩) চিকিৎসা সংকট:
হাসপাতাল ভেঙে পড়েছে, ওষুধ নেই, অস্ত্রোপচার চলছে অবশ না করেই।
এই তিন পরিস্থিতি মিলিয়ে একটি পুরো প্রজন্ম ধ্বংসের মুখে।
সমাধানের দাবি
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে—গাজার শিশুদের বাঁচাতে হলে অবিলম্বে করণীয় হলো—
- পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর যুদ্ধবিরতি
- আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের প্রবেশ নিশ্চিত করা
- চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ ও খাদ্য পাঠানো
- বোমাবর্ষণ বন্ধ
- শিশুদের নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করা
ইউনিসেফের মুখপাত্র রিকার্ডো পাইরেস বলেন—
“আমরা সব পক্ষকে অনুরোধ করছি—শিশুদের জীবনকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের হাত থেকে বাদ দিন। শিশুদের রক্ষা করা আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা।”
গাজায় যুদ্ধবিরতির পরও ৬৭ শিশুর মৃত্যু শুধু এক দিনের খবর নয়। এটি একটি অঞ্চলের, একটি জাতির এবং একটি পুরো মানবতার ট্র্যাজেডির প্রতিচ্ছবি। বিশ্ব যতদিন কার্যকর পদক্ষেপ না নেবে, গাজার শিশুদের মৃত্যু থামবে না—বরং আরও বাড়তে থাকবে।
মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে এখন সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ হলো—শিশুদের বাঁচানো। কারণ শিশু হারিয়ে গেলে ভবিষ্যৎ হারিয়ে যায়।
MAH – 13912 I Signalbd.com



