ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকাকে অবৈধ পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনমুক্ত করে নগরীর সৌন্দর্য এবং পরিবেশ রক্ষা করতে এবার কঠোর অবস্থানে গেছে নগর প্রশাসন। যত্রতত্র প্লাস্টিক ও অন্যান্য উপাদান দিয়ে তৈরি এসব প্রচার সরঞ্জাম দ্বারা কে কতটুকু বর্জ্য তৈরি করছে, তার ওপর জরিপ পরিচালনা করছে ডিএনসিসি। এই জরিপ শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে শীর্ষ দূষণকারী ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করা হবে। একই সাথে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এসব অবৈধ প্রচার সামগ্রী অপসারণ না করলে সংশ্লিষ্টদের কঠোর জরিমানা ও আইনানুগ ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হবে।
ডিএনসিসি’র কঠোর হুঁশিয়ারি: ৭ দিনের আল্টিমেটাম
মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এই বিজ্ঞপ্তিতে অবৈধভাবে ব্যানার-ফেস্টুন স্থাপনকারীদের জন্য ৭ দিনের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে।
- বিজ্ঞপ্তির বিষয়বস্তু: গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে, ডিএনসিসি এলাকায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অবৈধভাবে ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার এবং বাড়ি/ভবনের ছাদে/দেয়ালে বিজ্ঞাপনী নামফলক, সাইনবোর্ড, এলইডি, বিলবোর্ড ইত্যাদি স্থাপন করা হয়েছে।
- সাত দিনের সময়সীমা: অবৈধ স্থাপনাকারীদের আগামী ৭ (সাত) দিনের মধ্যে নিজ দায়িত্বে এসব ফলক/পোস্টার/ব্যানার/বিলবোর্ড/এলইডি অপসারণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
- আইনি ব্যবস্থা: নির্ধারিত সময়ের পর যদি কেউ এসব অপসারণ না করে, তবে উচ্ছেদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা ও অন্যান্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
দূষণকারী চিহ্নিতকরণে ডিএনসিসি’র বিশেষ জরিপ
ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ শুধু উচ্ছেদ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না। অবৈধ বর্জ্য তৈরির জন্য দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সামাজিকভাবে চিহ্নিত করতে তারা একটি বিশেষ জরিপ পরিচালনা করছে।
- জরিপের প্রক্রিয়া: সিটি করপোরেশনের কর্মীরা প্রতিদিন নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে অপসারিত ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারের পরিমাণ পরিমাপ করে রাখছেন। কার দূষণ কতটুকু, তার বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে।
- লক্ষ্য: এই জরিপের মাধ্যমে খুব শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করবে ডিএনসিসি, যেখানে শীর্ষ দূষণকারীদের নাম থাকবে। নগর প্রশাসন চায়, মানুষ যেন নিজেরাই এই দূষণকারীদের চিহ্নিত করে এবং তাদের প্রতি ঘৃণা তৈরি হয়।
- জরিমানার পরিকল্পনা: এই জরিপের ভিত্তিতে শুধু পরিচয় প্রকাশই নয়, শীর্ষ দূষণকারীদের দ্রুত জরিমানার আওতায় আনারও পরিকল্পনা করছে নগর প্রশাসন।
সূত্র জানিয়েছে, গত অক্টোবরে নগরজুড়ে ১ লাখ ২৫ হাজার অবৈধ ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণ করা হয়েছে।
শীর্ষ দূষণকারীর তালিকায় কারা?
নগর প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ডিএনসিসি’র এই জরিপে বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শীর্ষ দূষণকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
- রাজনৈতিক ব্যক্তি: জানা গেছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে যাওয়া বেশ কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থী অবৈধ প্রচার সামগ্রী লাগিয়ে পরিবেশ দূষণে শীর্ষ তালিকায় রয়েছেন। এর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত একাধিক প্রার্থীর নাম উঠে এসেছে বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
- ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান: এছাড়া বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও এই তালিকায় রয়েছে, যারা বিজ্ঞাপনের নামে নগরীর বিভিন্ন স্থানে অনুমতি ছাড়া বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড এবং এলইডি স্ক্রিন স্থাপন করেছে।
শীর্ষ দূষণকারীদের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের পর তা নিয়ে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী মহলে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ডিএনসিসি প্রশাসকের বক্তব্য: কেন এই কঠোর সিদ্ধান্ত
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ গণমাধ্যমকে বলেছেন, এই কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে পরিবেশ ও নগরীর সৌন্দর্য রক্ষার বিষয়টিই মুখ্য।
তিনি বলেন, “আমরা প্রতিনিয়ত পোস্টার, ব্যানারের আবর্জনা পরিষ্কার করছি আর কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান লাগিয়েই যাচ্ছে। এটা এভাবে চলতে পারে না।” তিনি আরও যোগ করেন, “যত্রতত্র লাগানো এসব পোস্টার-ব্যানার শুধু নগরীর সৌন্দর্যই নষ্ট করছে না, ব্যাপক প্লাস্টিক দূষণও করছে। এটা নগরের পরিবেশ ও মানুষের জন্য চরম ক্ষতিকর।”
মোহাম্মদ এজাজ দৃঢ়ভাবে জানান, “তাই এবার আমরা এসব দূষণকারীদের সমাজের কাছে পরিচিত করে দেওয়া এবং জরিমানার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেন মানুষই দূষণকারীদের ঘৃণা করতে শেখে।”
নির্বাচনী প্রার্থীদের প্রতি ডিএনসিসি’র আহ্বান
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থীরা যেন অবৈধ প্রচার সামগ্রী ব্যবহার করে পরিবেশ দূষণ না করেন, সেই বিষয়েও বিশেষভাবে সতর্ক করেছে ডিএনসিসি।
- পরিবর্তনের অংশীদার: ডিএনসিসি প্রশাসক প্রার্থীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন, তারা যেন একটি পরিচ্ছন্ন পরিবর্তনের অংশীদার হন। তিনি উল্লেখ করেন, ঢাকায় দুই সিটি করপোরেশনের মালিকানা এবং বেসরকারি মালিকানায় অসংখ্য বিজ্ঞাপন বোর্ড রয়েছে এবং বর্তমানে ডিজিটালি প্রচারণারও অনেক সুযোগ রয়েছে।
- পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থা: মোহাম্মদ এজাজ বলেন, “আমরা বহুদিন ধরে তাদের অনুরোধ করছি, তারপর তিরষ্কার করবো, তাতেও না হলে জরিমানা করবো। প্রয়োজনে প্রার্থীর নাম ধরে ধরে নির্বাচন কমিশনের অভিযোগ করবো।”
তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, কোনোভাবেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঢাকা উত্তর সিটি এলাকায় অবৈধভাবে পরিবেশ দূষণ করতে দেওয়া হবে না।
“আমরা প্রতিনিয়ত পোস্টার, ব্যানারের আবর্জনা পরিষ্কার করছি আর কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান লাগিয়েই যাচ্ছে। তাই এবার আমরা এসব দূষণকারীদের সমাজের কাছে পরিচিত করে দেওয়া এবং জরিমানার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেন মানুষই দূষণকারীদের ঘৃণা করতে শেখে।” — মোহাম্মদ এজাজ (প্রশাসক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন)
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃক অবৈধ পোস্টার-ব্যানারের মাধ্যমে সৃষ্ট দূষণকারীদের তালিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে নগর প্রশাসন শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ নয়, বরং সামাজিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করতে চায়। ৭ দিনের আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার পর ডিএনসিসি কী ধরনের কঠোর ব্যবস্থা নেয় এবং শীর্ষ দূষণকারীদের নাম প্রকাশ হলে সমাজে তার কী প্রভাব পড়ে, সেদিকেই এখন সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ। এই উদ্যোগ সফল হলে রাজধানী ঢাকা একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা পাবে, তেমনি নির্বাচনের সময়ও প্রচারণার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
এম আর এম – ২৩০৭,Signalbd.com



