দেশের সংবিধান সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনর্গঠনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) বহুল আলোচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ জারি করেছেন। এ আদেশ জারির মাধ্যমে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হলো।
রাষ্ট্রপতির আদেশের গেজেট বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রকাশিত হয়। গেজেট প্রকাশের মধ্য দিয়েই শুরু হয় গণভোট প্রস্তুতির আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া। এ গণভোটে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নতুন সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে।
গণভোটের মাধ্যমে জনগণের রায় নেওয়া হবে
আদেশ অনুযায়ী, আসন্ন গণভোটে জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের অংশগ্রহণে দীর্ঘ আলোচনার পর যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করা হয়েছে, সেগুলিই গণভোটে স্থান পাবে।
আদেশে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন গণভোট পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আইন, বিধি ও নীতিমালা প্রণয়ন করবে। কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ ও ভোটগ্রহণের সময়সূচি নির্ধারণ করবে।
তেজগাঁওয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন
এর আগে, বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া উপস্থাপন করা হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে তা অনুমোদন দেওয়া হয়।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মুখ্য সচিব সাংবাদিকদের জানান, “এই আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কারের একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় শুরু হলো। জনগণের অংশগ্রহণ ও মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার নতুন কাঠামো গঠনের প্রক্রিয়া এখন বাস্তব রূপ পেতে যাচ্ছে।”
জুলাই সনদের পটভূমি
২০২৫ সালের জুলাই মাসে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করা হয়। কমিশনের লক্ষ্য ছিল দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন, বিচারব্যবস্থার সংস্কার এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা।
কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি, সদস্য হিসেবে ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকারকর্মীরা।
দীর্ঘ চার মাসের সংলাপ, জনমত জরিপ ও খসড়া প্রণয়নের পর কমিশন জুলাই মাসে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবনা তৈরি করে, যার নাম দেওয়া হয় ‘জুলাই জাতীয় সনদ’।
জুলাই সনদের মূল প্রস্তাবসমূহ
১. নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি
কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে আরও শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
২. বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা
উচ্চ আদালতের নিয়োগ ও পদোন্নতির প্রক্রিয়া নতুনভাবে নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়।
৩. স্থানীয় সরকারে বিকেন্দ্রীকরণ
ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধি ও প্রশাসনের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলা হয়।
৪. রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতান্ত্রিক সংস্কার
দলীয় গঠনতন্ত্রে অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা ও স্বচ্ছ তহবিল ব্যবস্থার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
৫. নাগরিক অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আইন সংস্কারের সুপারিশও এতে রয়েছে।
গণভোট: জনগণের হাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আদেশ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বড় মাইলফলক। কারণ প্রথমবারের মতো জনগণের সরাসরি রায় নেওয়া হবে সংবিধান সংস্কারের মতো গুরুতর বিষয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহসানুল করিম বলেন,
“এটি কেবল একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, এটি গণতন্ত্রের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের প্রতীক। জনগণ যদি গণভোটে অংশগ্রহণ করে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ ঘটবে।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
আদেশ জারির পর দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
শাসক জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “এটি জনগণের হাতে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ তুলে দেওয়ার এক সাহসী সিদ্ধান্ত।”
অন্যদিকে, বিরোধী দলগুলোর কিছু অংশ জানিয়েছে, তারা গণভোটে অংশ নেবে, তবে কমিশনের স্বচ্ছতা ও ভোটগ্রহণ পদ্ধতি নিয়ে তাদের কিছু প্রশ্ন রয়েছে।
একজন বিরোধী নেতা বলেন,
“আমরা গণভোটের বিপক্ষে নই, তবে এর প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ। নির্বাচন কমিশনকে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার ফারজানা রহমানের মতে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ সংবিধান সংস্কারের পথে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
তিনি বলেন,
“বাংলাদেশের সংবিধান সময়ের প্রয়োজনে অনেকবার সংশোধিত হয়েছে। তবে এবার যে প্রস্তাবগুলো এসেছে, সেগুলো জনগণের সরাসরি মতামতের ভিত্তিতে যাচাই হবে—এটি এক নতুন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।”
তিনি আরও বলেন,
“এ ধরনের গণভোটের মাধ্যমে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব, যদি প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়।”
গণভোট কবে অনুষ্ঠিত হতে পারে
নির্বাচন কমিশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যেই গণভোট আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হবে। ভোটগ্রহণের সম্ভাব্য সময় আগামী জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ।
গণভোটের প্রশ্নপত্রে থাকবে সংবিধানের নির্দিষ্ট কিছু ধারার সংস্কার বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-ধরনের প্রশ্ন। প্রতিটি ভোটার নির্দিষ্ট প্রতীক চিহ্ন দিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারবেন।
জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণভোট নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।
কর্মজীবী মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরাও মনে করছেন—যদি গণভোট সুষ্ঠু হয়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি আরও স্থিতিশীল হতে পারে।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রাকিবুল ইসলাম বলেন,
“আমরা চাই পরিবর্তন, কিন্তু সেটি হোক জনগণের হাতে। গণভোট যদি সঠিকভাবে হয়, তাহলে সবাই ফলাফল মেনে নেবে।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র পর্যবেক্ষণ সংস্থা (IDEA), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) ও জাতিসংঘ বাংলাদেশ সরকারের এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা জানিয়েছে, গণতান্ত্রিক সংস্কারের এই প্রক্রিয়ায় তারা প্রযুক্তিগত সহায়তা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে আগ্রহী।
জাতিসংঘের এক মুখপাত্র বলেন,
“জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় গণভোট সম্পন্ন করবে।”
সংবিধান সংস্কারের ইতিহাস
বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালে প্রণীত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। প্রতিবারই তা সংসদের মাধ্যমে করা হয়েছে। কিন্তু এবারই প্রথমবারের মতো সংবিধান সংস্কারের সিদ্ধান্ত গণভোটের মাধ্যমে নেওয়া হবে।
এটি দেশের ইতিহাসে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
রাষ্ট্রপতির জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ কেবল একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়—এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চার নতুন মাইলফলক। জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং সাংবিধানিক সংস্কারের এই প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে প্রবেশ করবে—যেখানে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে জনগণ নিজেই।
MAH – 13787 I Signalbd.com



