বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত অধ্যায়— জুলাই-আগস্ট গণহত্যা—এর বিচারিক প্রক্রিয়া আজ পৌঁছেছে এক সিদ্ধান্তমূলক পর্বে। দীর্ঘ তদন্ত, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও বিচারকাজ শেষে আজ বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) ঘোষণা হতে পারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের মামলার রায়ের দিন।
ট্রাইব্যুনালের ঘোষণা আজ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের একটি বিচারিক প্যানেল আজ দুপুরে রায়ের দিন ঘোষণা করবেন। আদালত সূত্র জানিয়েছে, মামলার দীর্ঘ শুনানি শেষে গত ২৩ অক্টোবর বিচারকাজ সমাপ্ত হয়। সে সময় আদালত আজকের দিনটি রায়ের তারিখ নির্ধারণের জন্য স্থির করেছিলেন।
কারা আসামি
মামলায় মোট তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
১. শেখ হাসিনা – সাবেক প্রধানমন্ত্রী
২. আসাদুজ্জামান খান কামাল – সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
৩. চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন – সাবেক আইজিপি (পুলিশ প্রধান)
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে, ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে গণআন্দোলনের সময় রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও দলীয় সন্ত্রাসীদের নির্দেশ দিয়ে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা, গুম ও নির্যাতন করা হয়েছিল। অভিযোগপত্রে বলা হয়, এটি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এক মানবতাবিরোধী অপরাধ, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের চরম লঙ্ঘন।
পলাতক ও আটক আসামি
তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার সময় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান পলাতক রয়েছেন। তাঁরা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশত্যাগ করেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বর্তমানে কারাগারে বন্দি এবং আদালতে উপস্থিত থেকে নিজের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি মামলায় রাজসাক্ষী হিসেবেও আংশিক সাক্ষ্য দিয়েছেন।
মামলার পটভূমি
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তীব্র গণআন্দোলন। দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ, র্যাব ও দলীয় সন্ত্রাসীরা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায় বলে অভিযোগ উঠে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ঐ সময় অন্তত ১৮০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত, কয়েক হাজার আহত এবং বহু শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ নিখোঁজ হন।
এ ঘটনাকে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা “জুলাই-আগস্ট গণহত্যা” হিসেবে আখ্যা দেয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তখন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানায়।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
২০২৪ সালের শেষদিকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেও আলোচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন একাধিকবার বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারকে “অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের” জন্য দায়ী করে বিবৃতি দেয়।
পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নতুনভাবে পুনর্গঠিত হয় এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে “জুলাই-আগস্ট গণহত্যা মামলা” নামে তদন্ত শুরু করে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০২৫ সালের শুরুর দিকে অভিযোগ গঠন করা হয় শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে।
রায় ঘোষণার আগের নিরাপত্তা ব্যবস্থা
আজকের রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, ও সংলগ্ন এলাকায় সেনা ও পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে সেনাসদরে একটি চিঠি পাঠানো হয়, যেখানে আদালতের আশপাশে অতিরিক্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আজকের দিনটি অত্যন্ত সংবেদনশীল। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা রোধে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ
রায়ের দিন ঘোষণার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এক সময়ের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের আসামি—এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব ঘটনা।
নতুন সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, এ বিচার বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পুনর্জাগরণ নির্দেশ করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগপন্থী কিছু প্রবাসী সংগঠন ও সমর্থকরা দাবি করছেন, এটি “রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিচার।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ মামলার রায় দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক অবস্থানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে। যদি আদালত শেখ হাসিনা ও অন্যদের বিরুদ্ধে কঠোর রায় দেন, তবে সেটি হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অবস্থান
বাংলাদেশ মানবাধিকার ফোরাম (বিএইচআরএফ) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, তারা রায়ের প্রতি পূর্ণ সম্মান জানাবে, তবে এ ধরনের বিচারে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা জরুরি।
বিএইচআরএফ-এর পরিচালক রুবিনা রহমান বলেন, “জুলাই-আগস্টের ঘটনাগুলো কোনো রাজনৈতিক বিরোধ ছিল না, এটি ছিল নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ভয়াবহ উদাহরণ। যদি প্রমাণের ভিত্তিতে দোষীরা সাজা পায়, তবে এটি বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনবে।”
আসন্ন রায়ের গুরুত্ব
আজকের রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধবিচারের আরেকটি অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। ২০১০ সালে শুরু হওয়া যুদ্ধাপরাধবিচারের পর এ মামলাকে অনেকেই দেশের “দ্বিতীয় বড়তম ট্রায়াল” হিসেবে দেখছেন।
রায়ের দিন ঠিক হওয়ার পরই পুরো জাতি তাকিয়ে থাকবে আদালতের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে। আদালত যদি রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করে, তবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মূল রায় প্রকাশ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার ভূমিকা দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত ও বিতর্কিত। একসময় স্বাধীনতার উত্তরাধিকারের দাবিদার এই নেতা আজ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি।
আজকের দিনটি তাই কেবল একটি বিচারিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। দেশের মানুষ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং ইতিহাস—সবাই অপেক্ষা করছে সেই রায়ের জন্য, যা হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করবে।
MAH – 13777 I Signalbd.com



