আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণায় প্রথমবারের মতো পোস্টার ও ড্রোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নতুন প্রকাশিত আচরণবিধিতে প্রচারণায় পরিবেশবান্ধব ও ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিদেশে প্রচারণা চালানো ও প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
ইসির ঘোষণায় নতুন যুগের সূচনা
মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) বিকেলে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এক ব্রিফিংয়ে কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ নতুন আচরণবিধির বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “প্রচারণায় কোনো ধরনের পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন বা প্লাস্টিক উপকরণ ব্যবহার করা যাবে না। এর পরিবর্তে ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করা যেতে পারে।”
এই নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রার্থীরা প্রচারণায় ডিজিটাল ব্যানার, ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে, টেলিভিশন বিজ্ঞাপন, এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারবেন। তবে এসব ব্যবহারে অবশ্যই ইসির নির্ধারিত নীতিমালা মেনে চলতে হবে।
আচরণবিধির গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ
নতুন প্রকাশিত ‘রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধি ২০২৫’–এ কয়েকটি বড় পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
- প্রচারণায় কোনো পোস্টার, প্লাস্টিক বা ব্যানার ব্যবহার নিষিদ্ধ
- ড্রোন ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ
- বিদেশে প্রচারণা চালানো যাবে না
- প্রতি নির্বাচনী আসনে সর্বোচ্চ ২০টি বিলবোর্ড স্থাপন করা যাবে
- সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারে কড়া নিয়ম প্রযোজ্য
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) বা ডিপফেক ব্যবহার করা যাবে না
- আচরণবিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড ও দেড় লাখ টাকা জরিমানার বিধান
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, এই বিধিমালা লঙ্ঘন করলে শুধু প্রার্থীর নয়, সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলকেও আর্থিক জরিমানার মুখে পড়তে হবে। গুরুতর অপরাধ প্রমাণিত হলে প্রার্থিতাও বাতিল হতে পারে।
পোস্টার নিষিদ্ধের কারণ
ইসি সূত্রে জানা যায়, গত কয়েকটি নির্বাচনে পোস্টার ও ব্যানার তৈরিতে ব্যাপক প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়েছে, যা পরিবেশ দূষণের বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নির্বাচন শেষে এসব পোস্টার সরাতে সময় লেগেছে কয়েক সপ্তাহ, এবং সেগুলো বর্জ্য আকারে জমে থেকে পরিবেশের ক্ষতি করেছে।
তাছাড়া, বড় বড় শহরে বিদ্যুতের খুঁটি, দেয়াল, এমনকি সরকারি ভবনের গায়ে পোস্টার লাগানোয় সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে। এই পরিস্থিতি বিবেচনা করেই ইসি এবার পোস্টার নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ইসির এক কর্মকর্তা জানান, “আমরা চাই, নির্বাচন যেন পরিবেশবান্ধব হয়। তাই প্রচারণায় পোস্টার বন্ধ করে ডিজিটাল মাধ্যমের দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে।”
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া
ইসির এই সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ডিজিটাল প্রচারণা সময়োপযোগী এবং পরিবেশবান্ধব। তারা মনে করে, এটি নির্বাচনী ব্যয়ও কিছুটা কমাবে।
অন্যদিকে, বিরোধী দলের একাধিক নেতা মনে করেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো ইন্টারনেট কাভারেজ দুর্বল। তাই শুধুমাত্র ডিজিটাল প্রচারণা গ্রামীণ ভোটারদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
একটি মধ্যমপন্থী দলের নেতা বলেন, “ডিজিটাল প্রচারণা ভালো উদ্যোগ, কিন্তু পোস্টার পুরোপুরি বন্ধ না করে সীমিতভাবে ব্যবহার করার সুযোগ রাখা উচিত ছিল।”
আচরণবিধি বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি
ইসির সিনিয়র সচিব জানিয়েছেন, আচরণবিধি বাস্তবায়নে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মনিটরিং টিম গঠন করা হচ্ছে। এসব টিম প্রতিদিন মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ করে কমিশনে পাঠাবে।
এছাড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের ওপরও বিশেষ নজর থাকবে। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কেউ ভুয়া তথ্য বা বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ছড়ালে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইসির এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা চাই নির্বাচনী পরিবেশ যেন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ থাকে। এজন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণ বাড়ানো হচ্ছে।”
ড্রোন নিষেধাজ্ঞার কারণ
নির্বাচনী প্রচারণায় ড্রোন ব্যবহার নিষিদ্ধের বিষয়ে কমিশনের যুক্তি, এটি নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অতীতে কিছু এলাকায় রাজনৈতিক সমাবেশে ড্রোন ওড়ানোর ঘটনা ঘটেছে, যা নিরাপত্তা বাহিনীর উদ্বেগের কারণ হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, নির্বাচনের আগে ও চলাকালীন সময়ে কোনো দল বা প্রার্থী প্রচারণার কাজে ড্রোন ব্যবহার করতে পারবে না। শুধুমাত্র ইসির অনুমোদনপ্রাপ্ত টিভি চ্যানেল বা সংস্থা সংবাদ সংগ্রহের কাজে ড্রোন ব্যবহার করতে পারবে।
নির্বাচনী সংলাপ ও পরবর্তী পদক্ষেপ
ইসি সচিব জানিয়েছেন, আচরণবিধি প্রকাশের পর বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু হবে। সেখানে নির্বাচনী প্রস্তুতি, তফসিল ঘোষণা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
নির্বাচনী এলাকার সীমানা সংক্রান্ত কিছু জটিলতা রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। আদালতের রায় পর্যালোচনার পরই চূড়ান্ত তফসিল নির্ধারণ করা হবে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব হাসান মনে করেন, “ইসি এবার একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। পোস্টার নিষিদ্ধ করলে পরিবেশ বাঁচবে এবং অর্থ ব্যয়ও কমবে। তবে গ্রামীণ ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর বিকল্প ব্যবস্থাও থাকতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ডিজিটাল প্রচারণা ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেয়। তবে এর সঠিক বাস্তবায়নই চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করবে।”
পোস্টার ও ড্রোন নিষিদ্ধের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন দেশের নির্বাচনী প্রচারণায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি শুধু পরিবেশ রক্ষার পদক্ষেপ নয়, বরং নির্বাচনী প্রচারে আধুনিকতা ও স্বচ্ছতার প্রতীক হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
তবে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—ডিজিটাল প্রচারণা কি সত্যিই সব শ্রেণির ভোটারের কাছে পৌঁছাতে পারবে? এখন সবার দৃষ্টি ইসির পরবর্তী পদক্ষেপ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দিকে।
এম আর এম – ২১৮৫,Signalbd.com



