ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) প্রজ্বল রেভান্নাকে গৃহকর্মীকে ধর্ষণের দায়ে বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। ৩৪ বছর বয়সী প্রজ্বল রেভান্না ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়ার নাতি। এনডিটিভি’র প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, শনিবার (২ আগস্ট) বেঙ্গালুরুর এমপি-এমএলএদের জন্য গঠিত বিশেষ আদালতের বিচারক সন্তোষ গজানন ভাট এই রায় ঘোষণা করেন। পাশাপাশি প্রজ্বলকে ১১ লাখ রুপি জরিমানা করা হয়েছে।
ধর্ষণ মামলার বিস্তারিত:
ভুক্তভোগী নারী প্রজ্বল রেভান্নার পরিবারের মালিকানাধীন ফার্মহাউসে গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করতেন। অভিযোগ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে কর্ণাটকের হাসান জেলায় প্রজ্বলের বিরুদ্ধে চারটি ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে একটি মামলার শুনানি সম্পন্ন হয়েছে এবং বিচারক প্রজ্বলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। বাকি তিনটি মামলার বিচার এখনও চলমান রয়েছে।
প্রজ্বল রেভান্নার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি শোষিত গৃহকর্মীকে বারংবার ধর্ষণ করেছেন। এছাড়া তাকে বিভিন্ন সময়ে যৌন হয়রানি করেছেন। এই মামলা নিয়ে এলাকায় ব্যাপক সমালোচনা ও বিক্ষোভ হয়েছে।
আদালতে আবেদনের প্রেক্ষাপট ও রায়:
সাজা ঘোষণার সময় প্রজ্বল রেভান্না কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি আদালতে স্বীকার করেন, “আমি দোষী। আমার একটি পরিবার আছে, ছয় মাস ধরে মা-বাবাকে দেখিনি। দয়া করে আমাকে কম শাস্তি দিন।” তবে বিচারক তার আবেদনে কোন করুণা করেননি এবং আইনের কঠোরতা বজায় রেখে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন।
রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ:
প্রজ্বল রেভান্নার পরিবার অভিযোগ করেছে, এই মামলা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। তাদের দাবি, কর্ণাটকের বর্তমান ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দল এই ষড়যন্ত্রের পেছনে রয়েছে। প্রজ্বলের বিরুদ্ধে একাধিক যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ও ব্যক্তিগত মতবিরোধের জেরেই তাকে রাজনৈতিকভাবে টার্গেট করা হয়েছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে হাসান আসনে প্রজ্বল রেভান্না হেরে যান, যা ওই দলের ষড়যন্ত্রের অংশ বলে পরিবারের দাবি।
গ্রেফতারের প্রেক্ষাপট:
২০২৪ সালের ৩১ মে, জার্মানি থেকে দেশে ফেরার সময় প্রজ্বলকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পেছনে ছিল একাধিক নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের ভিডিও ও তথ্যের ভিড়। অভিযোগ উঠে, ইউরোপে পালানোর আগে সে এসব কাণ্ডে জড়িয়ে ছিল। গ্রেফতারের পর থেকে সে কারাগারে বন্দী।
ভারতের ধর্ষণ আইনের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা:
ভারতে ধর্ষণের মামলা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই সামাজিক ও আইনগত বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ২০১৩ সালের ‘দক্ষিণ দিল্লি গণধর্ষণ’ কাণ্ডের পর ধর্ষণ আইনে অনেক কঠোর শাস্তির বিধান আনা হয়েছে। বর্তমানে ধর্ষণ অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত শাস্তির সুযোগ রয়েছে। বিচার প্রক্রিয়াও অনেক দ্রুততর করা হয়েছে। তবে, বাস্তবে এখনও অনেক ধর্ষণ মামলা বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার শিকার হয় এবং শিকারী নারীরা নানাভাবে সমাজের নানা বাধার মুখোমুখি হন।
কর্ণাটকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির প্রতিবেদন:
কর্ণাটক রাজ্য, যেখানে প্রজ্বল রেভান্নার মামলাটি ঘটেছে, সেখানে ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানি মামলার সংখ্যা ২০২০ সাল থেকে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় গৃহকর্মীদের প্রতি যৌন হয়রানি ও শোষণ একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজ্যে ২০২৪ সালে ধর্ষণ মামলার সংখ্যা প্রায় ৪ হাজারেরও বেশি রেকর্ড করা হয়েছে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও বিক্ষোভ:
প্রজ্বল রেভান্নার যাবজ্জীবন সাজার খবর প্রকাশ পেতেই বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও মহিলা অধিকার কর্মীরা স্বাগত জানান। তারা বলেছেন, “এই রায় দেশের আইনের শাসন এবং নারীর নিরাপত্তার জন্য একটি বড় বার্তা।” তবে, কিছু রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা অভিযোগ তুলেছে, বিচারপতি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে থাকতে পারেন।
ভুক্তভোগী নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা:
ভুক্তভোগী নারীদের অধিকার রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই মূল চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ এবং ভারতের মত দেশের জন্য এটি একটি যুগান্তকারী বিষয়। শুধু আইন প্রয়োগই নয়, সামাজিক সচেতনতা ও নারীর সুরক্ষা নীতির উন্নয়নও জরুরি।
প্রজ্বল রেভান্নার ভবিষ্যৎ:
কারাগারে থাকা অবস্থায় প্রজ্বল আপিল করবে কি না, সেটি এখন দেখার বিষয়। তার আইনজীবীরা ইতোমধ্যেই উচ্চ আদালতে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
প্রজ্বল রেভান্নার যাবজ্জীবন সাজা শুধু এক ব্যক্তির শাস্তি নয়, এটি দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার এক নিদর্শন। একই সঙ্গে, এটি নারীর নিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষায় আরও শক্তিশালী পদক্ষেপের আহ্বান। কর্ণাটক এবং গোটা ভারতেই গৃহকর্মীদের প্রতি সহিংসতা ও শোষণ কমাতে সরকার এবং সমাজের সব স্তরকে আরও সচেতন হতে হবে।
MAH – 12094 , Signalbd.com



