বাংলাদেশ

রংপুরে গাছের পাতা থেকে হচ্ছে তেল, প্রতি লিটারের দাম ৫০ হাজার!

Advertisement

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী ইউনিয়নের শ্রীকান্ত গ্রামে অস্ট্রেলিয়ান টি ট্রি গাছের পাতা থেকে উৎপাদিত হচ্ছে উচ্চমূল্যবান তেল। এই তেলের প্রতি লিটার দাম প্রায় ৫০ হাজার টাকা। শুধু তেলই নয়, উৎপাদনের সময় বের হওয়া হাইড্রোসল ওয়াটারেরও চাহিদা রয়েছে, যা প্রতি লিটারে এক হাজার টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান আরিফ এই উদ্যোগের মূল ব্যক্তি। তিনি এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছেন।

উৎপাদনের পদ্ধতি ও আধুনিক প্রযুক্তি

তেল উৎপাদনের জন্য প্রথমে গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করা হয়। এরপর পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে স্টিলের চৌবাচ্চায় রাখা হয়। পরে এই পাতাগুলো চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা স্টিম ডিস্টিলেশন পদ্ধতিতে তাপ দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় পাতা থেকে ধীরে ধীরে অ্যাসেনশিয়াল অয়েল এবং হাইড্রোসল ওয়াটার সংগ্রহ করা হয়।

প্রতিদিন ৫০ কেজি পাতা ব্যবহার করে তিন ব্যাচে প্রায় দেড় লিটার তেল উৎপাদন করা যায়। এই তেল এবং হাইড্রোসল ওয়াটার দেশের সঙ্গে বিদেশেও রফতানি করা হয়।

উদ্যোক্তার গল্প ও সংগ্রামের দিনগুলি

তরুণ প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান আরিফ আগে তাইওয়ানের একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করতেন। চাকরির সময় তার মনে আসে টি ট্রি গাছের পাতা থেকে তেল উৎপাদনের ধারণা। শুরুতে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বিদেশ থেকে চারা আনা সম্ভব হয়নি। ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে অল্প বীজ সংগ্রহ করেন। তবে বীজ থেকে চারা উৎপাদন করার সময়ও তিনি নানা সমস্যার সম্মুখীন হন।

তিন বছরের প্রচেষ্টার পরে ৪০টি চারা থেকে সফলভাবে চারা উৎপাদন করেন এবং এখন তার এক একরের প্রকল্পে ২ হাজারের বেশি টি ট্রি গাছ রয়েছে।

চাষের চ্যালেঞ্জ ও উদ্ভাবন

গাছ বড় হওয়ার পর পাতার থেকে তেল উৎপাদন করতে গিয়ে প্রকৌশলী আরিফ নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। চীনের ছোট একটি মেশিন আনার মাধ্যমে তিনি তা বিশ্লেষণ করে স্থানীয়ভাবে ৫০০ লিটার ধারণক্ষমতার মেশিন তৈরি করেন। এখন এই মেশিন ব্যবহার করে সফলভাবে তেল ও হাইড্রোসল উৎপাদন করছেন।

প্রতিটি গাছ থেকে বছরে গড়ে পাঁচ কেজি পাতা সংগ্রহ হয়। প্রতি কেজি পাতার থেকে গড়ে ১০ গ্রাম তেল এবং ১৮–২০ লিটার হাইড্রোসল ওয়াটার পাওয়া যায়।

তেলের ব্যবহার ও বাজার চাহিদা

উৎপাদিত টি ট্রি তেল ত্বক সতেজ রাখতে, খুশকি দূর করতে এবং চুল পড়া রোধে কার্যকর। হাইড্রোসল ওয়াটার স্কিন কেয়ার ও হেয়ার কেয়ার পণ্যে ব্যবহৃত হয়। বিদেশেও এর চাহিদা বেশি। বিশেষ করে যাদের ত্বকে ব্রণ বা ফাঙ্গাসজনিত সমস্যা আছে তাদের জন্য তেলটি খুব কার্যকর।

প্রকৌশলী আরিফ জানান, “ট্রি পাতার তেল ও হাইড্রোসল ওয়াটার বিশ্বব্যাপী স্কিন কেয়ার, হেয়ার কেয়ার ও ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যে ব্যবহৃত হয়। সরকারের সহযোগিতা পেলে রফতানি আরও সহজ হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।”

স্থানীয় কৃষি বিভাগের সহায়তা

পীরগাছা উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম জানান, রংপুরের মাটি টি ট্রি গাছের জন্য উপযোগী। শুরু থেকেই কৃষি বিভাগ এই প্রকল্পে সহযোগিতা করেছে। তিনি আরও বলেন, “যদি আরও কেউ এমন উদ্যোগ গ্রহণ করেন, আমরা সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করব।”

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও কর্মসংস্থান

প্রকল্পটি বর্তমানে ১০–১২ জন মানুষের জন্য স্থায়ী কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। প্রতিবছর উৎপাদিত তেলের পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এই উদ্যোগ গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলবে এবং দেশের নাম বিশ্বের বাজারে পৌঁছাবে।

রংপুরে গাছের পাতা থেকে তেল উৎপাদনের এই প্রকল্প দেশের জন্য একটি নতুন উদ্ভাবনী দৃষ্টান্ত। সফল উদ্যোক্তা আসাদুজ্জামান আরিফের প্রচেষ্টা ও স্থানীয় কৃষি বিভাগের সহায়তা এই প্রকল্পকে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দিক দেখাচ্ছে। ভবিষ্যতে এর রফতানি ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বিশ্লেষকদের মতে অত্যন্ত আশাপ্রদ।

এম আর এম – ২১৩৯,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button