বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নৌ কূটনৈতিক সম্পর্কের নতুন অধ্যায় উন্মোচন হলো চট্টগ্রাম বন্দরে। চার দিনের শুভেচ্ছা সফরে শনিবার সকালে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে পাকিস্তান নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ পিএনএস সাইফ (PNS SAIF)। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেশের পর থেকেই জাহাজটিকে স্বাগত জানাতে তৈরি ছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যরা।
চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর পর ঐতিহ্যবাহী সামরিক সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে পাকিস্তানি জাহাজটিকে স্বাগত জানানো হয়। নৌবাহিনীর সুসজ্জিত বাদকদল বাজায় স্বাগত সঙ্গীত, আর ফুলেল শুভেচ্ছায় বরণ করে নেওয়া হয় অতিথিদের। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম নৌ অঞ্চলের কমান্ডারসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রতিনিধি এবং নৌবাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা।
সৌহার্দ্য আর সহযোগিতার প্রতীক ‘পিএনএস সাইফ’
পিএনএস সাইফ পাকিস্তান নৌবাহিনীর আধুনিক ফ্রিগেট শ্রেণির একটি যুদ্ধজাহাজ। এটি চীনে নির্মিত F-22P টাইপের জাহাজ, যা সর্বাধুনিক নৌযুদ্ধ সরঞ্জাম, রাডার ও অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা সজ্জিত।
২০০৯ সালে জাহাজটি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়। ১২৩ মিটার দীর্ঘ ও ৩,০০০ টন ওজনের এই জাহাজে রয়েছে অত্যাধুনিক টর্পেডো, ক্ষেপণাস্ত্র এবং হেলিকপ্টার পরিচালনার সুবিধা।
এ ধরনের জাহাজ মূলত নৌ টহল, উপকূলীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক মহড়ায় অংশগ্রহণের জন্য ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে জাহাজটি বর্তমানে “গুডউইল মিশন” বা শুভেচ্ছা সফরের অংশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সফর করছে।
নৌবাহিনীর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যা জানা গেছে
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শুভেচ্ছা সফরের অংশ হিসেবে পাকিস্তানি জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করার পর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা জানানো হয়।
এ সময় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ বানৌজা স্বাধীনতা তাদের সমুদ্রসীমায় প্রবেশের সময় আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা জানায়।
নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই সফর দুই দেশের নৌবাহিনীর মধ্যে বন্ধুত্ব, পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতার নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। পাশাপাশি, এটি দক্ষিণ এশিয়ায় নৌ কূটনীতি জোরদার করার একটি ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশে অবস্থানকালে জাহাজের বিভিন্ন কর্মসূচি
চার দিনের সফরে পিএনএস সাইফের অধিনায়কসহ কর্মকর্তারা কমান্ডার চট্টগ্রাম নৌ অঞ্চল, কমান্ডার বিএন ফ্লিট ও এরিয়া সুপারিনটেনডেন্ট ডকইয়ার্ড–এর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
এছাড়া জাহাজের কর্মকর্তা, নাবিক ও প্রশিক্ষণার্থীরা চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করবেন।
তাদের জন্য নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ভ্রাতৃত্বমূলক বিনিময় আয়োজনের পরিকল্পনাও রয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যরাও পিএনএস সাইফ পরিদর্শন করবেন, যা দুই বাহিনীর মধ্যে প্রযুক্তিগত ও পেশাদার অভিজ্ঞতা বিনিময়ে সহায়ক হবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে সফরের গুরুত্ব
বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় নৌ কূটনীতির গুরুত্ব বেড়েছে বহুগুণে। ভারত মহাসাগর অঞ্চলে নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ তাদের নৌবাহিনীকে কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তান, উভয় দেশই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সেই সঙ্গে দুই দেশের নৌবাহিনী আন্তর্জাতিক মহড়ায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বহুপাক্ষিক সহযোগিতা বাড়াচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে পিএনএস সাইফের সফরকে শুধু সৌজন্য সফর নয়, বরং ভবিষ্যতের কৌশলগত সহযোগিতার সম্ভাবনা হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান নৌ সম্পর্ক: অতীত ও বর্তমান
১৯৭১ সালের পর রাজনৈতিক সম্পর্ক নানা কারণে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সামরিক যোগাযোগ ধীরে ধীরে পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে।
উভয় দেশই আঞ্চলিক শান্তি, সমুদ্র নিরাপত্তা ও মানবিক সহযোগিতার বিষয়ে পারস্পরিক আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
২০০৭ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীর জাহাজ “পিএনএস তিপু সুলতান” বাংলাদেশ সফর করেছিল। এরপর দীর্ঘ বিরতির পর আবারও পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজের আগমন কূটনৈতিক অঙ্গনে ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে।
চট্টগ্রাম নৌ অঞ্চল: দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দু
চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রবন্দর। এ বন্দর বাংলাদেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র এবং নৌবাহিনীর প্রধান ঘাঁটিগুলোর একটি।
এখান থেকেই দেশের নৌ টহল, উপকূলীয় নিরাপত্তা, নৌ প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক নৌ সহযোগিতার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
তাই বিদেশি নৌবাহিনীর শুভেচ্ছা সফরগুলো সাধারণত চট্টগ্রাম থেকেই অনুষ্ঠিত হয়, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জোরদারে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
পাকিস্তানি জাহাজ সফরের প্রতিক্রিয়া
চট্টগ্রামের স্থানীয় জনগণ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ সফর নিয়ে আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। অনেকেই মনে করছেন, এ ধরনের সফর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব ও আস্থার বার্তা বহন করে।
বিশেষ করে নৌবাহিনীর তরুণ সদস্যরা এমন সফর থেকে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পান।
নৌবাহিনীর এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন,
“বাংলাদেশ নৌবাহিনী শান্তি, সহযোগিতা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় বিশ্বাসী। পিএনএস সাইফের এই সফর দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে।”
চার দিনের কর্মসূচির শেষ দিন
পাকিস্তান নৌবাহিনীর জাহাজটি ১২ নভেম্বর সকালে বাংলাদেশ ত্যাগ করবে। বিদায়ের আগে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করা হবে।
তাতে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধি ও পাকিস্তান হাইকমিশনের সদস্যরা।
কূটনৈতিক আস্থা ও শান্তির সেতুবন্ধন
চট্টগ্রামে পিএনএস সাইফের সফর নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার নৌ কূটনীতির এক বন্ধুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সফর দুই দেশের নৌবাহিনীর মধ্যে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়ানোর পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকেও আরও সুসংহত করবে।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণ, আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব ও সামুদ্রিক নিরাপত্তায় অবদানের সঙ্গে এই সফর ভবিষ্যতের সহযোগিতার দরজা খুলে দিচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা পিএনএস সাইফ শুধু একটি যুদ্ধজাহাজ নয়, এটি দুই দেশের বন্ধুত্বের প্রতীক, সমুদ্র-নির্ভর সহযোগিতার বার্তাবাহক এবং দক্ষিণ এশিয়ার নৌ কূটনীতির নতুন সূচনা।
MAH – 13677 I Signalbd.com



