বাংলাদেশ

অবৈধভাবে শত শত মুসলিমকে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে ভারত

Advertisement

 আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত সরকার আইন লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের সীমান্তে শত শত বাঙালি মুসলিম ও রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ‘পুশ-ইন’ করছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও টানাপোড়েন সৃষ্টি হচ্ছে।

ভারতীয় সীমান্তে বেআইনি ‘পুশ-ইন’ কার্যক্রম: কী বলছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) সম্প্রতি এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত বেআইনিভাবে শত শত বাঙালি মুসলিম এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও ন্যায়বিচার প্রক্রিয়ার চরম লঙ্ঘন।

প্রতিবেদন অনুসারে, এই ধরনের পুশ-ইন কার্যক্রম ২০২৪ সালের মে মাস থেকে আরও তীব্রভাবে শুরু হয়েছে, বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে। বহু ভারতীয় নাগরিক, যাদের পূর্বপুরুষের শিকড় এই উপমহাদেশেই, এমনকি যাদের কাগজপত্র রয়েছে, তারাও এই বেআইনি প্রত্যাখ্যাত প্রক্রিয়ার শিকার হয়েছেন।

কীভাবে শুরু হলো এই বিতাড়ন প্রক্রিয়া

ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত দীর্ঘদিন ধরেই অভিবাসন ও রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ভারতের বিজেপি সরকার এই অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ তকমা দিয়ে দেশে থেকে বিতাড়িত করার প্রক্রিয়া জোরদার করেছে।

২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে জম্মু ও কাশ্মিরে এক হামলার ঘটনার পর থেকেই ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর দমনমূলক পদক্ষেপ আরও বাড়িয়ে দেয়। এর জের ধরেই বহু মুসলিম নাগরিককে বেআইনি উপায়ে সীমান্ত পার করিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো শুরু হয়।

প্রভাবিত জনগোষ্ঠী ও ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, তারা গত জুন মাসে ৯টি ঘটনার তদন্ত করে এবং মোট ১৮ জন ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে। অনেকে জানিয়েছেন, ভারতের আসাম, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, ওড়িশা ও রাজস্থান রাজ্য থেকে তাদের ধরে আনা হয় এবং বিএসএফ জোরপূর্বক সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়।

এমনকি কিছু ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও বাংলাদেশে পাঠানো হয়। শুধু মে মাসেই ১০০ জনের মতো রোহিঙ্গাকে আসাম রাজ্য থেকে পাঠানো হয় এবং জাতিসংঘ জানিয়েছে, আরও ৪০ রোহিঙ্গাকে সমুদ্রপথে মিয়ানমারের দিকে সাঁতরে যেতে বলা হয়, যা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের শামিল।

আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ভারতের এই পুশ-ইন প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, জাতিগত বৈষম্য বিলোপ কনভেনশন ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন। কাউকে রাষ্ট্রচ্যুত করার আগে তাকে আইনি সহায়তা, কারণ ব্যাখ্যা এবং আপিল করার অধিকার দেওয়া বাধ্যতামূলক। অথচ এসব কোনো প্রক্রিয়াই মানা হচ্ছে না।

এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন, “সরকার যেভাবে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশ’ বন্ধের কথা বলছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বরং এতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে মানবাধিকার পদদলিত করা হচ্ছে।”

বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান ও প্রতিবাদ

বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ২০২৫ সালের ৮ মে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারত সরকারকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে জানায়, এ ধরনের বেআইনি পুশ-ইন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। চিঠিতে বলা হয়, শুধুমাত্র প্রমাণসাপেক্ষে বাংলাদেশি নাগরিকদেরই ফেরত নেওয়া হবে।

বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) জানিয়েছে, ৭ মে থেকে ১৫ জুনের মধ্যে প্রায় ১৫০০ মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশুকে ভারত সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু রোহিঙ্গাও রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভবিষ্যৎ উদ্বেগ

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের কাজ কেবল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন নয়, বরং দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্কের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পাশাপাশি বাংলাদেশে ইতিমধ্যে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটকে আরও জটিল করে তুলবে এই নতুন প্রবাহ।

এছাড়া, বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ২০২৬ সালের ভারতের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি তাদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আরও উসকে দিতে পারে, যার পরিণতি হতে পারে আরও বড় মানবিক সংকট।

সারসংক্ষেপ  

ভারত সরকারের এই বিতাড়ন নীতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মানবাধিকারের প্রশ্নে বড় বিতর্ক তৈরি করেছে। অনেক ভারতীয় নাগরিক নিজ দেশে থাকার অধিকার হারাচ্ছেন, আবার বাংলাদেশকেও বাড়তি বোঝা বহন করতে হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের কার্যক্রম যদি চলতেই থাকে, তাহলে তা কেবল দুই দেশের সম্পর্কেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এখন দেখার বিষয়, আন্তর্জাতিক চাপ এবং কূটনৈতিক উদ্যোগ এই সংকট নিরসনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে কিনা।

এম আর এম – ০৫০৬, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button